চারদিকে থৈ থৈ পানি, কলার ভেলায় ভাসিয়ে শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে মা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৫:৩৮:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৩৪ বার পড়া হয়েছে
সাত বছরের শিশু তানিম হোসেন শুভ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। টানা কয়েকদিন ধরে আক্রান্ত শিশুটি। উপায় না পেয়ে তানিমকে তার মা জেসমিন আক্তার কলা গাছের ভেলায় ভাসিয়ে হাসপাতালে দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তামিমদের ঘরে বন্যার পানি। ঘরের বাহির, উঠান, মাঠ-ঘাট সবখানে অথৈ জল। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ধরে তাদের পরিবারটি পানিবন্দি।
বন্যার পানি দিন দিন দূষিত হয়ে পড়ছে। চারিদিকে পানি থৈ থৈ করলেও সুপেয় পানির অভাব রয়েছে তাদের বাড়িতে। এসব কারণেই শিশু তামিম এখন ডায়েরিয়া আক্রান্ত। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সে এখন পাতলা পায়খানা ও বমি করছে। তাই উপায় না পেয়ে হাঁটুপানি মাড়িয়ে তার পরিবার তাকে কলার ভেলায় ভাসিয়ে হাসপাতালে দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
শিশু তামিমের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের যাদৈয়া গ্রামে। তামিমের মতো ওই এলাকার অনেক শিশু বন্যার দূষিত পানির কারণে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ডায়রিয়া, এলার্জি এবং খোসপাঁচড়া জাতীয় রোগবালাইতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। শিশুরা শুধু যে রোগাক্রান্ত হচ্ছে, তা নয় তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনও ব্যাহত হচ্ছে।
তানিমের মা জেসমিন বলেন, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাড়িতে পানি। খাবার পানির সংকট। মাঝে-মধ্যে বোতলজাল পানি পেলেও সেটা পর্যাপ্ত নয়। বন্যার পানিতে অর্ধেক ডুবে থাকা চাপাকলের পানি পান করতে হচ্ছে আমাদের। শিশুরাও সে পানিই পান করে। তাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে আমার ছেলে। কয়েকদিন ধরে পাতলা পায়খানার পর এখন বমিও হচ্ছে। অবস্থা খারাপ বিধায় হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, বন্যার পানিতে শিশুদের রোগাক্রান্ত হওয়া ছাড়াও স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে। আমার ছেলে বাড়ির অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতো। দৌঁড়াদৌড়ি করতো। কিন্তু পানির কারণে তাদের খেলাধুলা বন্ধ। পানিতে নামতে পারে না, দূষিত পানিতে শরীর চুলকায়।
যাদৈয়া গ্রামের ফাতেমা বেগমের কন্যাশিশু মুনতাহা জ্বর এবং সর্দিতে ভুগছে। ফাতেমা তার শিশুটিকে কোমর পানি মাড়িয়ে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।তিনি বলেন, চারিদিকে পানি। আমার শিশুটি গত কয়েকদিন ধরে জ্বর ও সর্দিতে আক্রান্ত। কিন্তু পানির কারণে তাকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়নি। এখন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাই উপায়ন্তর না পেয়ে কোমার পানি মাড়িয়ে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।যাদৈয়া গ্রামের নোয়া বাড়ির বাসিন্দা তাছলিমা আক্তারও ভেলায় ভাসিয়ে তার শিশু ছেলে মেহরাজ হোসেন মিরাজকে গ্রাম্য এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। বন্যার পানির কারণে তার ছেলে জ্বরে আক্রান্ত। সে ডায়েরিয়া এবং বমিও করছে। অবস্থা এমন যে পরনের কাপড় বার বার নষ্ট করছে শিশুটি। ভয়াবহ অবস্থার কারণে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে ওষুধপত্র নিয়ে আসেন তার মা তাছলিমা।
একই এলাকার মর্জিনা আক্তারের শিশু আলিফা আক্তার গেল দুই সপ্তাহ ধরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। জেলা সদর হাসপাতালে নিয়েছেন শিশুটিকে, সেখান থেকে চাঁদপুরের মতলব ডায়রিয়া হাসপাতালে নিয়েছেন। কিন্তু পুরোপুরি ভালো হয়নি। বাড়িতে নিয়ে আসার পর আবার ডায়রিয়া শুরু হয় শিশুটির। তাই এবার চন্দ্রগঞ্জের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেলেন শিশুটিকে।একই এলাকার বিবি খাদিজা জানান, তার তিন বছর বয়সী শিশুকন্যা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে গেছে। আর ৯ বছরের ছেলে আবদুল্লাহ বন্যার দূষিত পানির কারণে চর্মরোগে আক্রান্ত। তার শরীরে গোটা উঠেছে।
গত কয়েকদিনে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে পানিবন্দি লোকজনকে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। এদের বেশিরভাগই শিশু। তারা ডায়রিয়া এবং চর্মজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দা নুর হোসেন বলেন, দীর্ঘ সময় বন্যার পানি জমে থাকা এবং বন্যার পানিতে বিভিন্ন ধরনের মৃত জীব পচে পানি দূষিত হচ্ছে। ওই পানিতে বাধ্য হয়ে শিশুরা চলাচল করে। এতে খোসপাঁচড়াসহ নানা রোগবালাই হচ্ছে।
তিনি জানান, এলাকার যে সব টিউবওয়েল পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে যায়নি, ওইসব টিউবওয়েলের পানি পান করছে বন্যার্ত বাসিন্দারা। শিশুরাও সে পানি পান করছে। বন্যাকবলিত এলাকার টিউবওয়েলর পানি পুরোপুরি নিরাপদ নয়৷ ফলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন।
জেলা সিভিল সার্জন আহমেদ কবীর বলেন, বন্যার কারণে ডায়রিয়া, চর্ম ও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। শিশু ছাড়াও সব বয়সীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাদের ৫৮ ইউনিয়নে থাকা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালসহ ৬৪টি মেডিকেল টিমের মাধ্যমে বন্যার্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।