আখড়াবাড়িতে বাউল সাধুর মেলা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৯:০২:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ৩১ বার পড়া হয়েছে
বাউল সাধু ও ভক্তরা একাগ্রচিত্তে গেয়ে চলেছেন.‘আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে। হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায় ঘিরে নিল কালে।’ অসংখ্য বাউল, সাধু, গুরু, বৈষ্ণবের আগমনে এখন মুখরিত কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, আর প্রেমজুড়ির তালে মাতোয়ার হয়ে উঠেছেন বাউলরা। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের মৃত্যুর ১৩৪ বছর ধরে এভাবেই বাউল সাধকরা জড়ো হন বাউলতীর্থে।
এবার ১৭ অক্টোবর সাঁইজির তিরোধান দিবস হওয়ায় এর কদিন আগে থেকে ভক্তরা আসতে শুরু করেন আখড়া বাড়িতে। এক উদাসি টানে মানুষ ছুটে এসেছেন দলে দলে, হাজারে হাজারে। যেখানে মিলন ঘটেছে নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষের। কেউ এসেছেন ধবধবে সাদা পোশাকে, আবার কেউ গেরুয়া বসনে। সাঁইজির টানে এ ধামে বাউল ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেছে। সমাধিতে গাঁদা ফুল, আতর, গোলাপ ছড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন হাজারো শিষ্য-ভক্ত।
এদিকে উৎসবে শামিল হতে দেশের বাইরে থেকে ছুটে এসেছেন অনেকে। ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর, মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কুল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’ এ রকম অসংখ্য লালনসংগীতের সুরের মূর্ছনায় তারা মাতিয়ে তুলেছেন বাউলধাম। লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলেরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন গানে গানে। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করছেন না ভক্তরাও। দূর-দূরান্ত থেকে সাদা বসনে বাউল সাধকরা এসেছেন দলে দলে একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, প্রেমজুড়ি, চাকতি, খমক হাতে।
শুক্রবার দুপুরে বাউলের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন-ভক্ত, সাধু-গুরু মরা কালীগঙ্গায় গোসল সেরে পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। বৃষ্টির কারণে পুণ্যসেবা গ্রহণ করতে কিছুটা দেরি হলেও তাতে ক্ষোভ নেই বাউল ও ভক্তঅনুসারীদের। তখন বেলা সোয়া ৩টা। লালন একাডেমির প্রধান ফটক বন্ধ। ভিতরে লাইন দিয়ে কলাপাতা সামনে নিয়ে হাজার হাজার সাধু ফকিরের অপেক্ষা। সবাই খাবার পাবার পর বিশেষ আওয়াজ দিয়ে জানিয়ে দেয়া হলো বিতরণ শেষ। এবার খাওয়া শুরু হলো একযোগে। মাছ, ভাত, সবজি ও মিষ্টান্ন দিয়ে লালনধামে আসা বাউল, সাধু ফকির পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। আজ শনিবার বিদায় নেবেন সাধুর বাউলরা।
কোন সে উদাসী ডাকে মানুষ ছুটে আসে দলে দলে, হাজারে হাজারে। তা কেউ জানে না। লালন ধামের ভেতর পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী বাউল সখিরন তার সহযোগীদের নিয়ে একতারা হাতে নেচে-গেয়ে সাঁইজির বন্দনা করছিলেন। কথার পিঠে কথা আর মনের ভেতর আধাত্ম্যবাদ নিয়ে গাইছিলেন তিনি। কামিরন বলেন, লালন নিজেও এভাবে গান করতেন। তার কাছে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের বিচার ছিল না। পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয়হীন নারীদের তিনি বাঁচার সুযোগ করে দিতেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন। নাচতেন। কোনো এক অচিন গাঁয়ের অচেনা মানুষ ফকির লালন এখানে বসেই জীবনভর সন্ধান করেছেন, অচিন পাখির সহজ কথায় বেঁধেছেন জীবনের গভীরতম গান। এদিকে বাউল স¤্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৪ তিরোধান দিবসের ৩দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার ২য় দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন এদেশের বিশিষ্ট কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। শাহীনুর রহমান নামে এক দর্শনার্থী বলেন,’লালনের গানে মানবতা বোধ, অহিংস ভাব ও অসা¤প্রদায়িক চেতনার কারণে দিন দিন তার গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। লালন সাঁইজির এ আদর্শ অনুসরণ করলে দেশে বর্তমান হানাহানি বন্ধ হয়ে যেত বলে মনে করেন তিনি।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে লালন তিরোধান দিবসের আয়োজন।