সাত খুন: দণ্ডিতদের সাজা না হওয়ায় হতাশ নিহতের স্বজনরা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৯:৫০:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ৬৬ বার পড়া হয়েছে
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন ঘটনার ১০ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণ হয়েছিলো সিটি করপোরেশনের তৎকালিন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জন। তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে তাদের লাশ ভেসে উঠে। ২০১৮ সালে উচ্চ আদালত মামলাটির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করলেও এখনো কার্যকর হয়নি। গত ৫ বছর ধরে মামলাটি সুপ্রিম কোটে আটকে আছে শুনানির অপেক্ষায়। দীর্ঘ দশ বছরেও দন্ডিতদের সাজা কার্যকর না হওয়ায় হতাশ নিহতের স্বজনরা।
ঘটনার দশ বছর কেটে গেলেও বিভীষিকাময় সেই দিনের স্মৃতি ভুলতে পারেননি নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। এখনো আতঙ্কে দিন কাটে তার। অজানা ভয় তাড়া করে বেড়ায় তাকে।
তিনি বলেন, এই শোক মেনে নেয়ার মত না। সেই ট্রমা এখনো তাড়া করে বেড়ায় আমাদের। কিন্ত সব যুদ্ধ তো মায়ের করতে হয়। অনেক যুদ্ধ করে পিতৃছায়া হারা সন্তানদের বড় করেছি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যারা আমার স্বামীকে মেরেছে তারা অনেক প্রভাবশালী। জেলে বসে বসে অনেক কিছু করছে। তাদের স্বজনরা ভালোই আছে। সবকিছু আগের মত, শুধু ধ্বংস হয়েগেছে সাতটি পরিবার।’ বলতে বলতে আচলে চোখের অশ্রু মুছলেন তিনি।
দীর্ঘ দশ বছর ধরে একই ঘটনায় নিহত ছেলে মনিরুজ্জামান স্বপন হত্যার বিচারের অপেক্ষা করছেন মুক্তিযোদ্ধা মো. হায়দার আলী খান। বিচার কাজ সময় নিলেও বার্ধক্য তাকে সময় দিচ্ছে না। হায়দার আলী বর্তমানে গুরুত্বর অসুস্থ্য অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি। মৃত্যুশয্যায় থাকা সত্বেও ছেলের হত্যাকারীদের সাজা কার্যকর করতে দেখতে চান এই পিতা।
নিহত স্বপনের ভাই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান রিপন লেন, প্রতিবছর এপ্রিল মাস আসলেই বাবা, মা অসুস্থ্য হয়ে পরেন। তবে এ বছর বাবার অসুস্থ্যতা অনেক বেশি। তিনি কথা ও খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বাবা কখনো বিচারের আশা ছাড়েননি। কিন্তু ভবিষ্যতে কি আছে জানি না।
তথ্যমতে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে আসেন তৎকালীন প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরকে। হাজিরা শেষে ঢাকার ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে তাদের অপহরণ করা হয়। ওই ঘটনা দেখে ফেলায় আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমও অপহৃত হন। এ ঘটনার তিনদিন পর শীতলক্ষ্যায় মেলে ৬ জনের মরদেহ। এরপর নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের মরদেহও নদীতে ভেসে ওঠে ১লা মে ।
লাশ উদ্ধারের পর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দুটি মামলা করেন।
২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি সাত খুনের মামলায় রায় ঘোষণা করে আদালত। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২৬ আসামির ফাঁসি ও ৯ জনকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দন্ডিত করেন। রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) জন্য মামলার নথিপত্রসহ রায় হাইকোর্টে পৌঁছায়, যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ওই মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট শাখা।
ন্মিম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ আসামি জেল আপিল ও আপিল করেন। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ২০১৮ সালের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ১১ আসামির দণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় উচ্চ আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া ৯ আসামির দণ্ড বহাল থাকে। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামিদের মধ্যে রয়েছেন র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ,লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা নূর হোসেন।
এরপর ২০১৯ সালে র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, এম মাসুদ রানা, আরিফ হোসেন এবং সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ দণ্ডিত আসামিরা পৃথক আপিল করেন।
সুপ্রিম কোর্টে করা আপিল গত ৫ বছর ধরে শুনানির অপেক্ষায় আছে বলে জানান বাদিপক্ষের আইনজীবী শাখাওয়াত হোসেন খান।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালতে মামলাটির রায় হয়েছে। রায় হওয়ার পর আসামীরা হাইকোর্টে আপিল করে, যা নিষ্পিত্তি হয়েছে। আপিল নিষ্পিত্তিতে হাইকোর্ট জর্জ কোটের রায় কিছু সংশোধন করে কিছু অপরাধীর রায় বহাল রেখে এবং কিছুদের সাজা কমিয়েছে। এরপর অপরাধীরা আপিল ডিভিশনে আবেদন করে। যা বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় আছে।
এড. শাখাওয়াত আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করেছিলাম মামলাটি অগ্রাধীকার দিয়ে দ্রুত শুনানি করার। কিন্তু আসামী ও রাষ্ট্রপক্ষ এমনটা চায় না। তারা চাইলে দ্রুত শুনানি সম্ভব। এটি একটি ওয়েল প্রুভড কেস।
এ বিষয়ে জানতে আসামীপক্ষের আইনজীবী খোকন সাহার মুঠফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।