শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব বিরোধী ১০০ শিক্ষকের তালিকা ও আমার প্রতিবাদ
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:৫৮:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৪ ১৮৫ বার পড়া হয়েছে
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব বিরোধী ১০০ শিক্ষকের তালিকা সম্বলিত একটি পোস্ট গতকাল থেকে ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি। কে বা কারা শিক্ষকদের এ তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছে তা আমার জানা নেই। তবে তাদের উদ্দেশ্য যে ভালো নয় এটা পরিষ্কার । আমি তালিকার ৮-১৩ নম্বর সিরিয়ালে আমার নিজ বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শ্রদ্ধেয় বেশ কয়েকজন শিক্ষকের নাম দেখতে পাচ্ছি।
এর মধ্যে তালিকার ১০ ও ১৩ নম্বরে থাকা সোহানা মেহবুব ও কানিজ ফাতেমা বর্ণা ব্যতীত বাকি সবাই আমার সরাসরি শিক্ষক । স্যারদের একাধিক ইয়ারে একাধিক কোর্সের ক্লাস করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে । আমার জানামতে তালিকার ৮নং সিরিয়ালের অধ্যাপক ড. গিয়াস শামীম, ১২ নং সিরিয়ালের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক বিভাগ থেকে ইতিমধ্যেই অবসর নিয়েছেন। আমি বাংলা বিভাগের ছাত্র হলেও আমার সময় কেটেছে সাংবাদিকতা করে। বিভাগের ছাত্র হলেও শিক্ষকদের ত্রুটি ধরতে বা সমালোচনা করতে পিছপা হইনি। এটা শিক্ষকরাও জানতেন। আনেক সময় শিক্ষকরাও আমাকে বিভাগের গোপন খবর আমাকে জানাতেন জনস্বার্থে। তালিকার ৮, ৯, ১১ ও ১২ নম্বরে যেসব শিক্ষকের নাম দেয়া হয়েছে তা সঠিক তথ্য নিয়ে করা হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি না । তালিকার ৮,৯, ১১ ও ১২ নম্বরে যাদের নাম আছে তাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তারা হিজাব বা পর্দা বা ধর্ম বিরোধী কোন কথা বলেছেন এমনটা আমি অতীতে দেখিনি। আমি যতদূর তাদের সম্পর্কে জানি তারা নিজেরাও ধর্ম-কর্মের সাথে জড়িত।
সম্প্রতি দেশে পরিবর্তন হয়েছে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে আমি ছিলাম প্রথম সারিতে। এখন আছি স্বৈরাচারের বিচার নিশ্চিত করতে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন ০৪ আগস্ট ছাত্র-জনতাকে গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে সুপ্রিমকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয় তিনজন আইনজীবীর পক্ষে। ওই রিটে আমি একইসাথে আবেদনকারী ও আইনজীবী। হাসিনার পতন না হলে আমার কি পরিণতি হতো তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। হয়তো কবরে নয়তো আয়নাঘরে আমার ঠাঁই হতো। আর রিটটি করা কালীন আমি অসুস্থ ছিলাম। হাঁটতে পারতাম না। ব্যথানাশক ঔষধ খেয়ে ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোর্টে গিয়েছি। রিটটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় রয়েছে। আর স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফেসবুকে ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখেছি।
দেশে পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে অত্যান্ত নীচু মন-মানসিকতার পরিচয় দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকদের হিজাব বিরোধী তকমা দেয়া হয়েছে। তালিকার ৮, ৯, ১১ ও১২ নম্বরে যাদের নাম দেয়া হয়েছে তাদের আমরা সবাই আদর্শ শিক্ষক হিসেবে জেনে এসেছি । একজন শিক্ষক কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব হতে তার অন্যতম উদাহরণ হলেন আমাদের এইসব শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে শুদ্ধ উচ্চারণে পাঠদান , মমতা মিশ্রিত গভীর জীবনবোধের সাথে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ প্রদানসহ আরও অনেক মানবিক উদাহরণ রয়েছে।
১২ নং সিরিয়ালের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক স্যারের চেয়ে নিপাট ভদ্র ও সৎ মানুষ আমি জীবদ্দশায় খুব কম দেখেছি । আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে ছাত্রদের কতটা মন্ত্রমুগ্ধ করা যায়, তা স্যারের ক্লাস করে বুঝেছি। হিজাব বিরোধী কথা তো দূরের কথা কোনো ধর্ম বিরোধী কথা বলতে আমি কখনো শুনিনি। স্যারকে সম্ভবত ২০২২ সালে আমি ফোন করি । স্যার তখন বিভাগের চেয়ারম্যান। আমার ফোন করার কারণ ছিল আমি এমফিল শেষ পর্ব শেষ না করেই লন্ডন চলে যাই বার-এট-ল করতে। দেশে ফিরে থিসিস জমা দিতে চাই। কিন্তু ততদিনে রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। একটা আবেদন বিভাগে দেই কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেটার খবর ছিল না। আবেদন অবশ্যই আগের চেয়ারম্যানের সময় দেয়া হয়েছিল। স্যার আমাকে স্নেহ নিয়ে বলেন, “তুমি তো এখন ব্যারিস্টার”। এসব ডিগ্রি তোমার কোন কাজে লাগবে না। আর তোমার রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তারপরও তুমি চাইলে আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো “। আর আবেদনটা অগ্রগতি না হওয়াতে স্যার দুঃখ প্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় যে কয়টি বিভাগ ছিল এরমধ্যে বাংলা বিভাগ অন্যতম। জনস্বার্থে সকল আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকরা ছিলেন সামনের সারিতে। হোক সেটা ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা বিভাগের শহীদ অধ্যাপক আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী, মোহাম্মদ আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কথা কে না জানেন।
আমি দায়িত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বললাম , এই লিস্টে ঢাবির বাংলা বিভাগের যেসকল শিক্ষকের নামে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন । আর আমি যাদের ক্লাস করিনি তাই তারা হিজাব বিরোধী কিছু বলেছেন কিনা জানিনা । এই লিস্টে ঢাবির বাংলা বিভাগের শ্রদ্ধেয় যেসকল শিক্ষকদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে , বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে আমি মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি। সেই সাথে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
লিস্টে ঢাবির অন্যান্য বিভাগ কিংবা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে সকল শিক্ষকের নামে অভিযোগ আনা হয়েছে , তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানিনা । পেশার খাতিরে যোগাযোগ থাকলেও বিভাগে ক্লাস নেয়ার সময় কে কি বলেছেন তা জানিনা। তাই আমার এ বক্তব্য তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কথিত তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের যেসব শিক্ষকের নাম দেয়া হয়েছে তাদেরকে কোন রকম হয়রানি করা হলে তাদের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে আমি সবসময় তাদের পাশে আছি। সেটা হোক আদালতে বা অন্য কোথাও। আর যারা এই কথিত তালিকা তৈরি করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আনতে প্রশাসনকে অনুরোধ জানাচ্ছি। দেশে এখন স্বৈরাচার নেই বটে। তবে তাদের দোসররা এখনো সক্রিয়। কথিত তালিকা প্রণয়ন তাদেরও কাজ হতে পারে।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ঢাবি বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র।