শিক্ষক সংকটে ধুকছে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৯:১৫:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪ ১৪৬ বার পড়া হয়েছে
দেশের অন্যতম বৃহত চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ৩৩১ শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১৫১ জন। ১৮০টি পদে কোন শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা নেই। অনুমোদিত পদের প্রায় ৬৫ ভাগেরও বেশী শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে।
প্রতিষ্ঠার প্রায় ৬০ বছর পরও ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, কিউরেটর, প্রভাষক, প্যাথলজিষ্ট, মেডিকেল অফিসার ও বায়োকেমিষ্টের মত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর অর্ধেকেরও পদায়ন নিশ্চিত হয়নি। বছর দু’য়েক আগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের কিছু নতুন পদ সৃষ্টি করা হলেও সে আলোকে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর ফলে শূন্য পদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। সংকট তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয়েছে।
এমনকি কলেজে শিক্ষক সংকটের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্র শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতেও চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভয়াবহ সংকট চলছে। পুরো হাসপাতালটিতে নানা অব্যবস্থা অনিয়ম আর চিকিৎসা ব্যবস্থায় নানা সংকটের মধ্যে অতি সম্প্রতি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বদল হয়েছে।
নতুন সভাপতি হিসাবে বরিশাল সদর আসনের এমপি ও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিমকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার রাতে তিনি বরিশালে সর্বস্তরের জনগণসহ হাসপাতাল ও কলেজ প্রশাসন নিয়ে এক বৈঠকে আগামী ৩ মাসে হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবা উন্নত করাসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। কিন্তু এখানে মেডিকেল কলেজ ব্যবস্থাপনায় কোন বেসরকারী কমিটি নেই। তবে সদর আসনের এমপি এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে কলেজের শিক্ষক সংকট সহ শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে তার নৈতিক দায় আছে বলেও মনে করছেন সাধারন মানুষ থেকে সচেতন মহল। তবে এব্যাপারে জাহিদ ফারুকের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আবদুল মোনয়েম খান বরিশাল মেডিকেল কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পরে ১৯৬৮ সালের ২০ নভেম্বর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার একমাত্র মেডিকেল কলেজটির উদ্বোধন করা হয়।কলেজটির নামাকরন করা হয় অবিভক্ত বাংলার গভর্ণর ও বরিশালের কৃতি সন্তান শের এ বাংলার নামে।
কিন্তু শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মচারীর সংকটে ঐতিহ্যবাহী এ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা ব্যবস্থা এখন চরম বিপর্যয়ের কবলে। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষক সংকটের মধ্যেও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে মঞ্জুরিকৃত পদের ৮০ ভাগ শিক্ষকও নিয়োগ না দেয়ায় সংকট ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কলেজটির প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডাঃ মোঃ ফয়জুল বাশার। তারমতে, শিক্ষক স্বল্পতার বিষয়টি আমরা নিয়মিত অবহিত করছি। শিক্ষক সংকটে এখানে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি চিকিৎসা শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৬৫ ভাগ শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় এখানের লেখাপড়ার মান নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে নতুন ১০টিসহ ৫০ জন অধ্যাপকের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৫ জন। নতুন ২৪ জন সহ ৫০ জন সহযোগী অধ্যাপকের স্থলে কর্মরত রয়েছেন ৪২ জন। আর ৪৩টি নতুন পদ সহ ১২৩ সহকারী অধ্যাপকের স্থলে আছেন মাত্র ৫৭ জন।
এছাড়াও চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ৮২ জন প্রভাষক, মেডিকেল অফিসার, প্যথলজিষ্ট,বায়োকেমেষ্ট্রি ও ফার্মাসিষ্ট পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৪৫ জন। প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের ২০৫ জন কর্মচারীর মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৯২ জন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির এনাটমি, মেডিসিন সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের পদগুলো শূন্য পড়ে আছে। কলেজের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, ফিজিওলজি, বায়োকেমেষ্ট্রি, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, প্যাথলজি, শিশু, ডার্মাটোলজী, নেফ্রোলজী, সাইকিয়েট্রি, ফিজিক্যাল মেডিসেন এন্ড রিহাবিলেটসন, নিউরো মেডিসিন, শিশু সার্জারী, নিউরোলজী, শিশু হেমাটলজী ও অনকোলজী, অর্থপেডিক সার্জারী, জেনারেল ও ক্লিনিক্যাল নিউরোসার্জারী, চক্ষু, অর্থোপেডিক সার্জারী ও ট্রমাটোলজী, রেডিও এন্ড ইমেজিং, বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারী, গ্যষ্ট্রোএন্টারোলজী, ইউরোলজী, হেমাটোলজী, হেপাটোলজী, নিউনেটালজী, জেনারেল ও ক্লিনিক্যাল নিউরোলজী, রিউমাটোলজী, জেনারেল ইএনটি, অটোলজী, রেনোলজী, হেডনেক সার্জারী, ইউরো গাইনোকোলজী এবং চিলড্রেন ডেন্টিষ্ট্রি বিভাগগুলোর অধ্যাপকের পদ ছাড়াও মেডিসিন বিভাগের ৬জন, সার্জারী বিভাগের ২জন ও গাইনী এন্ড অবস বিভাগের দুজন অধ্যাপকের পদগুলোতেই কোন শিক্ষক নেই দীর্ঘদিন যাবত।
এছাড়া, ফিজিওলজি, ফরেনসিক মেডিসেন, মাইক্রো বায়োলজী, কমিউনিটি মেডিসেন, ফিজিক্যাল মেডিসিন, নেফ্রোলজী, প্যাথলজি, নিউরো মেডিসিন, অর্থোপেডিক, নাক-কান-গলা, রেডিও থেরাপী, ইউরোলজী, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী, এন্ডোক্রাইনোলজী ও মেটাবলিক, নিউনোটলজী ও রিউমাটোলজী বিভাগে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের পদগুলোও শূন্য। পাশাপাশি রেসপিরেটরী মেডিসিন, হেপাটলজী, রেডিওথেরাপী, এনসথেসিওলজী, রেডিওলজী ও ইমেজিং, চক্ষু, স্পোর্টস মেডিসিন ও অর্থোসকপি, অর্থোপেডিক, সার্জারী, ফার্মাকোলিজী ও বায়োকেমেষ্ট্রি সহ আরো কয়েকটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদগুলো শূন্য পড়ে আছে দীর্ঘদিন ।
এমনকি কলেজটির এনাটমি, ডার্মাটোলজী, সাইকিয়াট্রি, গ্যাসট্রোএন্টারোলজী, জেনারেল ও ক্লিনিক্যাল নিউরো সার্জারী, স্পোর্টস মেডিসিন এন্ড অর্থোসকপি, এনেসথেসিওলজী, রেডিওথেরাপী, হেমাটোলজী, রেসপিরোটরী মেডিসিন, গাইনী, শিশু হেমাটোলজী এন্ড অনকোলজী, রিউমাটোলজী, জেনারেল ইএনটি, অটোলজী, রেনোলজী, হেডনেক সার্জারী, পেডিয়েট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজী এন্ড নিউট্রেশন, রিপোডাক্টিভ ক্রাইনোলজী এন্ড ইনপারলিটি, ফটোমেন্টারনাল মেডিসিন, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, ডেন্টিষ্ট্রি, সাইন্স অব ডেন্টাল মেটারিয়াল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেন্টাল ফার্মাকোলজী, পেরিওডেন্টোলজী, ডেন্টাল পাবলিক হেলতথ, ওরাল মেক্সিলোফেশিয়াল সার্জারী, কনজারবেটিব ডেন্টিষ্ট্রি এন্ড এন্ডোডন্টিকস, রিমোভেবল অর্থোডেন্টিক্স এবং রিমোভেবল প্রস্থোডেন্টিক্স বিভাগে কোন সহযোগী অধ্যাপক নেই। এমনকি এ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অনেক বিভাগেই অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের সব পদই শূন্য। বেশীরভাগ বিভাগেই শুধুমাত্র সহকারী অধ্যাপকের মত জুনিয়র শিক্ষকগণই চালাচ্ছেন। যারা নিজ পদ থেকে শুরু করে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক সহ বিভাগীয় প্রধানেরও দায়িত্ব পালন করছেন।
এমনকি ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে ১২৩ সহকারী অধ্যাপক পদের ৬৬টি পদই শূন্য পড়ে আছে। ফলে অনেক বিভাগে কোন শিক্ষকই নেই। প্রভাষক বা মেডিকেল অফিসার দিয়ে পুরো বিভাগের শিক্ষাক্রম চলছে বেশ কয়েকটি বিভাগে। কিন্তু প্রভাষক, মেডিকেল অফিসার, প্যাথলজি, বায়োকেমেষ্ট্রি ও ফার্মাসিষ্টের ৮২টি পদেরও ৩৭টি শূন্য পড়ে আছে।
এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডেন্টাল বিভাগে প্রতিবছর প্রায় অর্ধশত ছাত্রÑছাত্রী ভর্তি করা হলেও সেখানে শিক্ষা দেয়ার মত তেমন কোন শিক্ষকই নেই। ফলে শের এ বাংলা মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল বিভাগ থেকে যারা ‘পাস’ করে বের হচ্ছেন তাদের বিষয়েও নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে জনমনে। এমনকি এ বিভাগের ক্লিনিক্যাল শিক্ষার জন্য সংলগ্ন হাসপাতালটির ইনডোরের অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. ফয়জুল বাশার জানান, করোনাকালে ১৯ মাস ক্লাস বন্ধ ছিল। এসময়ে অনেক শিক্ষক অবসরে গেছেন। ফলে ঐসব শূন্যপদে জনবল নিয়োগে যে বিলম্ব ঘটে তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। সমস্যায় থাকলেও কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।