বনের জমি জবরদখল করে হা- মীমের সাম্রাজ্য
বনখেকো এ কে আজাদ
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:৪৬:২৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ অগাস্ট ২০২৪ ১৮০ বার পড়া হয়েছে
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নে শালবনের বুক চিড়ে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে হা- মীম ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক । বনের জমি জবরদখল করে গড়ে তোলা হা- মীমের এ সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে গ্রুপটির মালিক এ কে আজাদের সাথে বন বিভাগের দ্বন্দ্ব চলছে প্রায় দুই দশক ধরে । বনখেকো এ কে আজাদের অর্থ, পেশিশক্তি আর রাজনৈতিক প্রভাব ও দাপটের কাছে সব সময়ই বন বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসন অসহায়ত্ব স্বীকার করে এসেছে । হা- মীম গ্রুপের বেদখল করে নেওয়া বনের জমি উদ্ধার তো হয়ইনি বরং আরও নতুন জমি জবরদখল করা হয়েছে ।
বন বিভাগ বলছে, এই শিল্প পার্কটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অবজ্ঞা করা হয়েছে । হা- মীমের শিল্পপার্ক গড়ে উঠেছে বনের ভেতরে । এর বেশির ভাগই নিচু জমি, যা স্থানীয় ভাষায় ‘ বাইদ’ নামে পরিচিত । বাইদ ভরাট করে গড়ে তোলা শিল্প- কারখানার বর্জ্য ও বিষাক্ত( টক্সিক) রাসায়নিক পদার্থের উৎকট দুর্গন্ধ স্থানীয় জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে । হা- মীমের ওই শিল্পপার্কটি প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী বিস্তৃত । একপাশে দাঁড়িয়ে তাকালে অপর পাশ দেখা বা অনুমান করার উপায় নেই । শিল্পপার্কের অভ্যন্তরে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতে হয় সাইকেল, মোটরবাইক বা গাড়ি । এখানে প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলো হলো হা- মীম ডেনিমস লিমিটেড, হা- মীম স্পিনিং লিমিটেড এবং হা- মীম টেক্সটাইল লিমিটেড ।
জানা গেছে, বন বিভাগ হা- মীম গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি দায়ের করে ২০০৭ সালে । সে মামলা আজ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি । এরপর দফায় দফায় বন বিভাগের আরও জমি দখলে নিলে ২০১৮ সালে আরেকটি মামলা করা হয় । অন্যদিকে বন বিভাগকে ঠেকাতে চারটি মামলা দিয়ে রেখেছে হা- মীম গ্রুপ ।
বন বিভাগের দ্বিতীয় মামলাটির প্রেক্ষাপট ছিল হা- মীম গ্রুপের পুনরায় বনের জমি জবরদখল । এ সময় বন বিভাগের শ্রীপুর রেঞ্জের তত্ত্বাবধানে শিমলাপাড়া বিটের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীরা মিলে প্রায় আট একর জমি হা- মীমের জবরদখল থেকে উদ্ধার করে নতুন বাগান সৃজন করেন । এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে হা- মীম গ্রুপের মালিক এ কে আজাদ বেপরোয়া হয়ে ওঠেন । হা- মীম গ্রুপের পত্রিকা সমকাল- এর তৎকালীন সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে এ কে আজাদ এক রিপোর্টারের সহযোগিতায় দেখা করেন তৎকালীন বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের সঙ্গে । উপমন্ত্রী জ্যাকবের সমর্থন নিয়ে বনের জমি বেশি করে জবরদখল করা হয় । এর অসৎ উদ্দেশ্যটি ছিল কোনো কারণে যদি বনের জমি ছাড়তে হয় তাহলে যেন আগের দখল করা অংশটুকু থেকে যায় । একদিকে তৎকালীন বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবকে দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করে বন বিভাগের লোকজনকে বাড়াবাড়ি না করে চুপ রাখা হয় ।
অন্যদিকে ওই একই সময়ে শিমলাপাড়া বিটে সশস্ত্র মহড়া দেয় হা- মীম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী এ কে আজাদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী সাইফুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা । প্রায় ২০ জনের সেই দলের প্রত্যেকে অস্ত্রশস্ত্র উঁচিয়ে শাসিয়ে যায় শিমলাপাড়া বিটের সবাইকে ।
একজন বন কর্মকর্তা জানান, ওই সময় শিমলাপাড়া বিট থেকে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সাইফুল ও তার সহযোগীরা । বন বিভাগ স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে আপসরফা করে অপহৃত ওই বনকর্মীকে ১৫ দিন পর উদ্ধার করে আনে । ওই ঘটনায় একটি মামলা করার চেষ্টাও হয়েছিল । কিন্তু বনের তৎকালীন কর্মকর্তারা পরবর্তী নিরাপত্তার স্বার্থে তা আর করেননি ।
ওই বন কর্মকর্তা বলেন, ওই ঘটনার পর থেকে বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিট এবং রেঞ্জ কর্মকর্তা- কর্মচারীরা সব সময় আতঙ্কে থাকেন । ভয়ে কেউ হা- মীম গ্রুপের কাউকে কিছু বলতে যান না । কয়েক মাস আগে বনের জমি উদ্ধারে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নতুন করে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিলেও তা পালন করতে ভয় পান সংশ্লিষ্ট বনকর্মীরা ।
এক বন কর্মকর্তা বলেন, ‘ আমি বা আমাদের কেউ এখন হা- মীমের আশপাশেও যাই না । ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বন বিভাগের মোট ১৬ একর( প্রায় ৫২ বিঘা) জমি হা- মীম গ্রুপ কর্তৃক জবরদখল করা আছে । ঠিকমতো রেকর্ড পরিমাপ করলে দেখা যাবে, জবরদখল করা জমির পরিমাণ আরও অনেক বেশি ।
এ বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীবলেন, এ কে আজাদের সাথে বন বিভাগের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে । বিভিন্ন সময়ে আইনগত পরিধি অনুযায়ী এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেছি । কিন্তু তা কাজে আসেনি ।
গত জুলাইয়ে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে মন্তব্য চাইলে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক( রাজস্ব ও এলএ) সৈয়দ ফয়েজুল ইসলাম বলেন, জবরদখলকারীর বিরুদ্ধে নিয়মানুযায়ী বন বিভাগ থেকে একটা উচ্ছেদ প্রস্তাব জেলা প্রশাসনের এই দপ্তরে পাঠানো হয় । সেটি হাতে পেলে আমরা উচ্ছেদের ব্যবস্থা নিয়ে থাকি । হা- মীম গ্রুপের বিরুদ্ধে কোনো উচ্ছেদ নোটিশ আমরা পাইনি ।
এ ব্যাপারে ঢাকা কেন্দ্রীয় বন বিভাগের বন সংরক্ষক হোসাইন মুহাম্মদ নিশাদ বলেন, নিয়মানুযায়ী মামলা বিচারাধীন থাকলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উচ্ছেদ প্রস্তাব পাঠানো যায় না ।
এদিকে বনের অভ্যন্তরে হা- মীম গ্রুপের বিস্তৃত জমির সাথে লাগোয়া ব্যক্তিমালিকানার জমি পেলেই তা কিনে নেয়ার চেষ্টা করেন এ কে আজাদ । জমি কিনতে এলাকাভেদে তার একাধিক এজেন্ট কমিশন বা কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে লোক নিয়োজিত রয়েছে । এমনই একজন স্থানীয় মুলাইদ গ্রামের নাজমুল । ব্যক্তিমালিকানার জমির সাথে যুক্ত বন বিভাগের জমি বা খাস জমি শনাক্তকরণ করে কিনতে সহযোগিতা করেন ওই নাজমুল । এরপর ওই জমি কেনার লোভনীয় দরের প্রস্তাব দিয়ে ফাঁদে ফেলা হয় জমির মালিককে । অভিযোগ আছে স্থানীয় জমির মালিকদের প্রথমে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে বায়নাপত্র করা হয় । তারপর জমি দখলে নিয়ে আর অবশিষ্ট অর্থ পরিশোধ করা হয় না ।
এ রকমই একজন স্থানীয় তেলিহাটি ইউনিয়নের ধনুয়া মৌজার ফরিদপুর গ্রামের ইব্রাহিম মোল্লা । তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘ আমার জমি জবরদখল করে নিয়েছে হা- মীম গ্রুপ । বায়নাপত্র করার পর আর আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না ওই গ্রুপের লোকজন । আমি জমি ও অর্থ দুটিই হারিয়েছি । আমি তাদের গেট পর্যন্ত যেতে পারি । ভেতরে যেতে পারি না ।’ এ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় দলিলাদিও দেখান তিনি ।
বুধবার( ২৮ আগস্ট) মন্তব্য জানতে হা- মীম গ্রুপের কর্ণধার এ কে আজাদের একাধিক ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র- জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস । অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন ।
পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ আইনজীবী সমিতির( বেলা) প্রধান নির্বাহী হিসেবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সব সময় পরিবেশ সুরক্ষায় অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন । অতীতে পরিবেশ সুরক্ষায় আপসহীন জোরালো ভূমিকার কারণে তাকে রাজনৈতিক ও বিত্তবান প্রভাবশালীদের বিরূপ আচরণ ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে । বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ায় দেশ ও জনগনের বৃহত্তর স্বার্থে তার সর্বোচ্চ আইনগত বিধিবিধান প্রয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে ।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে লিগ্যাল প্রসেস বা আইনগত প্রক্রিয়াটাই আমরা অনুসরণ করব । এত বছর ধরে যে বনের ভেতরে কারখানাগুলো চলছে, তার জন্য হয় রাজনৈতিক প্রভাব আছে, নয়তো বন বিভাগের লোকজনের যোগসাজশ আছে । আমাকে বুঝতে হবে যে ভূমির রেকর্ড টেম্পারিং হয়েছে কি না । যদি তা হয়ে থাকে এবং দেখা যায় যে দখলকারীর কোনো ভূমি রেকর্ড নাই বা যেটা আছে সেটা সঠিক নয়, তাহলে তো বনের জমি উদ্ধারে পদক্ষেপটা সহজ হয়ে যাবে । মূলত আইনগত দিকটাতেই জোর দিতে হবে ।
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, অনেক সময় বন বিভাগের পক্ষে জমি দখল সম্পর্কিত অনেক মামলা আমি দেখেছি । প্রতিটি লিগ্যাল স্টেপেই বন বিভাগ হেরে যায় । যদিও গেজেট অনুযায়ী ভূমির রেকর্ড ও বাউন্ডারি লাইন করার ক্ষমতা বন বিভাগেরই রয়েছে । তারপরও বন বিভাগ হেরে যায় । প্রচলিত আইন অনুযায়ী যদি দেখি বন বিভাগের লিগ্যাল অবস্থান শক্ত আছে, তাহলে আমি অবশ্যই সে জমি রক্ষায় আমার আইনগত সব শক্তি প্রয়োগ করব ।
সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা আইন মেনে সংস্কার করব । আইনি ধারায় সংস্কার করব । বন ও ভূমিসংক্রান্ত বিদ্যমান আইন যতক্ষণ পর্যন্ত না সংস্কার করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমি বিদ্যমান আইনেই কথা বলব ।
সূত্র খবরের কাগজ