উত্তরে অকাল বন্যা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:০২:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৩৬ বার পড়া হয়েছে
ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পানি তিস্তায় বেড়েই চলেছে। এরমধ্যে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করে ১৮ সেঃ মিঃ উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার চরসহ নদী বেষ্টিত বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পানির স্রোত বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদীর পানি সমতল বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় অসময়ে উত্তরের ৫ জেলায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উজানে ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের কারনে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ ২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে তিস্তার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অনেক বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ওইসব অঞ্চল। পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে। এতে লালমনিরহাট জেলার ৮ হাজার মানুষ পানিপন্দি হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
রোববার (২৯সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫২দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমা ২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)।
নদী তীরবর্তি এলাকার বেশ কিছু রাস্তাঘাট ব্রীজ কালভার্ট ভেঙে গেছে পানির তোরে। আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্বক ক্ষতির শ্বঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সাথে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরে মাছ। মারাত্বক ঝুঁকিপুর্ন হয়ে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো। শনিবার রাতভর সলেডি স্প্যার বাঁধ ২ এর উপর দিয়ে অভার ফ্লো প্রবাহিত হয়। বাঁধ ভেসে যাওয়ায় শ্বঙ্কায় আতংকিত হয়ে পড়ে ভাটিতে থাকা শত শত পরিবার। স্থানীয়রা রাতে বালু ভর্তি বস্তা ফেলে রক্ষা করে।
তিস্তা চরের নিম্নাঞ্চলে প্লাবিত হয়ে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। দুই দিন ধরে চরম বিপদে আছেন তিস্তা পাড়ের মানুষ। গতরাতে তিস্তা পাড়ের মানুষ নিঘুম রাত কাটিয়েছেন। লালমনিহাটের আদিতমারি উপজেলার খুনিয়াগাছ এলাকায় তিস্তার পানি মানুষের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, আকষ্মিক বন্যায় জেলায় অন্তত ৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। পানিবন্দি পরিবার গুলোর মাঝে দ্রুত ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হবে।
এদিকে, রংপুরের গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলার ৩০ টি গ্রাম দেড় থেকে দুই ফুট পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়ায় ২০ হাজার পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, রোববার সকাল ৬ টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদ সীমার ২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯ টায় পানি একটু কমেছে তখন বিপ সীমার ১ দশমিক সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। দুপুর ৩ টার সময় আবারো ১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। অপরদিকে কাউনিয়া পয়েন্টে সকাল ৬ টায় বিপদ সীমার দশমিক ২৯ সেন্টিিিমটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো তবে দুপুর ৩ টায় তা বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো।
অন্যদিকে রংপুরের গঙ্গাচড়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদ সীমার মাত্র দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ২০ টি গ্রাম দেড় থেকে ২ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত২০ হাজার মানুষ। গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে লক্ষিটারী ইউনিয়নের চরইছলী,শংকরদাহ,নোহালী ইউনিয়ের চর বাগডোহরা,মিনারবাজার, দিলিপবাজার,নোহালীর চর,কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনকর চর ও আশ্রায়ন প্রকল্পের ৩শ বাড়ি ঘর সহ ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়াও আলমবিদিতর ও গঙ্গাচড়া সদর ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। বাড়ি ঘরের পাশাপাশি ওই ৫টি ইউনিয়নের আবাদী জমির ফসলও তলিয়ে গেছে। বাড়ি ঘরে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় বাড়ি ঘর তলিয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার নিকস্থ উচু স্থান ও সহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। অপরদিকে কাউনিয়া উপজেলার ঢুসমারা সহ ৫ টি দূর্গম চরাঞ্চলে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে ল²িটারী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল্লা আল হাদী জানিয়েছেন তাদের ইউনিয়নের ১০ টি গ্রামের পাচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর ভাবে দিন কাটাচ্ছে। নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে এতে করে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে, নোহালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফ আলী জানান তার ইউনিয়নের চরাঞ্চলের ৮টি গ্রাম ২ থেকে ৩ ফুট পানির নীচে তলিয়ে গেছে পানি বন্দি হয়ে পড়েছে ১০ হাজার মানুষ। এ ছাড়াও শত শত হেক্টর জমির আবাদী ফসল তলিয়ে গেছে।
এদিকে গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা নাহিদ তামান্না জানান, তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গঙ্গাচড়া উপজেলার পানি বন্দি মানুষদের জন্য ৭ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এছাড়াও শুকনো খাবার প্যাকেট দেয়া হয়েছে। তবে বানভাসি মানুষরা অভিযোগ করেছে তাদের কাছে এখনও কোন ত্রান এসে পৌছেনি।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহি প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান উজানে ব্যাপক বৃষ্টি হওয়ায় সেখান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল এবং রংপুর অঞ্চলে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি আরও বাড়তে পারে বলে আশংকার কথা জানান তিনি।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, রংপুর বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উজানে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের (>৮৯ মি.মি./২৪ ঘণ্টা) প্রবণতা কমে এসেছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পরবর্তী ২ দিন তা হ্রাস পেতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদীর পানি সমতল বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে এবং জেলাগুলোর সংশ্লিষ্ট চরাঞ্চল ও কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তবে পরবর্তী ২ দিনে তিস্তা নদীর পানি সমতল হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
অন্যদিকে আগামী ৩ দিন পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলার ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। পাশাপাশি বর্তমানে রংপুর বিভাগের অন্যান্য প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই অবস্থায় আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত রংপুর বিভাগের এসব নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং পরবর্তী ২ দিন এসব নদীর পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে।
এছাড়া রংপুর বিভাগের ব্রহ্মপুত্র নদ ও এর ভাটিতে যমুনা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। আগামী একদিন ব্ৰহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পরবর্তী ৪ দিন পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে এই সময়ে এসব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।