রূপসায় ভাটা না হলে পানি সরে না
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:৩৭:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪ বার পড়া হয়েছে
খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় সড়ক আছে প্রায় এক হাজার ২১৫টি। যার অধিকাংশই বৃষ্টি হলেই পানিতে ডুবে যায়। বৃষ্টি হলেই নগরের রয়েল মোড়, বাইতিপাড়া, মৌলভীপাড়া, টিভিবাউন্ডারী রোড, পিটিআই মোড়, টুটপাড়া জোড়াকল বাজার, মহির বাড়ি খালপাড়, রূপসা ঘাট, নতুন বাজার, গল্লামারি, গোবরচাকা নবীনগর, খালিশপুর মুজগুন্নি, বাস্তুহারা কলোনি, হাউজিং এলাকা, ফুলবাড়ি গেট, রেলিগেট, মহেশ্বরপাশা, দৌলতপুর, রায়েরমহল ও বয়রা বাজারসহ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সড়ক ও নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। অথচ নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খরচ করা হয়েছে বিপুল অংকের অর্থ।
নগরের পিটিআই মোড়ের বাসিন্দা মেজবাহ উদ্দিন বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই মোড়ের ছয়টি রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। গত দুই বছর আগে করা উঁচু স্থানগুলোর কারণে পানি দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকে। রূপসা নদীতে ভাটা শুরু না হলে এ পানি সরে না। তখন নোংরা পানির মধ্যেই চলাচল করতে হয় আমাদের। প্রতি বর্ষায় নগরের এমন জলাবদ্ধতার জন্য সিটি করপোরেশনকেই দায়ী করেন তিনি।
নাগরিকনেতারা নগরবাসীর এ দুর্ভোগের কারণ হিসেবে বলছেন, অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং ত্রুটিযুক্ত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কাজে ধীর গতির কারণে নগরবাসীর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না। বিশেষকরে রূপসা, ভৈরবসহ শহরঘেষা নদ-নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হলেও সেগুলোর ড্রেজিং বা খননের দিকে নজর না দিয়ে শুধুমাত্র নগরের নালা ভাঙ্গা-গড়ার কাজ চলছে। তাছাড়া নগরের ২২টি খালের অধিকাংশই প্রভাবশালীদে দখলের। এ কারণে বেশিরভাগ খালের আয়তন সংকুচিত হয়েছে। খালগুলোর এ অবস্থার কারণে শহরে পানির চাপ বাড়ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কোটি টাকা ব্যয়েও প্রকৃতপক্ষে নগর জলজটমুক্ত হচ্ছে না। সঠিক তদারকির অভাবে এ খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় কাজে আসছে না। এ কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী পদক্ষেপের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন খুলনার মানুষ।
আশরাফ-উজ-জামান আরও বলেন, শুধু নালা নির্মাণ করলেই হবে না, এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বর্জ্য পড়ে অধিকাংশ নতুন নালা ভরাট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কেসিসির নজরদারি কম।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, নগরের কিছু জায়গায় উন্নয়নকাজ চলমান থাকায় সেখানে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া শহরের তুলনায় ভৈরব ও রূপসা নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় জোয়ারের সময় উল্টো নদীর পানি নগরে প্রবেশ করে। এ কারণে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে সময় লাগছে।
নগরের মুজগুন্নি এলাকার আব্দুর রহমান বলেন, সড়ক ও নালার কাজ হলেও আমাদের ভোগান্তির কোনো কমতি হয়নি। বৃষ্টি হলেই নিচু এলাকা ডুবে যায়। সড়কটির পানি আবু নাসের হাসপাতাল ও নেভি স্কুলের মাঝখান দিয়ে যে নালা চলে গেছে, সেখান দিয়ে গিয়ে ময়ূর নদীতে পড়ে। নালা পাকা হয়ে যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে এক সময় বড় একটি খাল ছিল। প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলের কারণে এটি এখন একটি নালায় পরিণত হয়েছে। এ জন্য পানি নামতে পারছে না।
কেসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাসুদ করিম বলেন, শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন (প্রথমপর্যায়)’ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ। খরচ হয়েছে ৫০২ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে নগরের ১২শ’ কিলোমিটার নালা নির্মাণ কাজের ১৩৩ কিলোমিটার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। যার অগ্রগতি ১৩ শতাংশ। বাকি চার ধাপের কাজ করা সম্ভব হলে পুরো প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে।
প্রকল্পের মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ৩০ জুন করার প্রস্তাব দিলেও তা অনুমোদন হয়নি- উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, নতুন করে আবারও প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। তবে শহরঘেঁষা নদ-নদীর তলদেশ ভরাটের বিষয়টি স্বীকার করলেও নদীগুলো ড্রেজিংয়ের বিষয়ে প্রকল্পে কোন প্রস্তাবনা নেই বলেও জানান তিনি।
কেসিসি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে (প্রথমপর্যায়)’ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৮২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। প্রকল্প ব্যয় কমে দাঁড়ায় ৮২৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। মেয়াদ নির্ধারণ হয় ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। প্রকল্পে নালা নির্মাণ, খাল খনন, স্লুইসগেট, পাম্পহাউস নির্মাণসহ ১৭৭টি কাজ করার কথা ছিল।
কেসিসি সূত্র বলছে, প্রকল্পের আওতায় গত ছয় বছরে ১০৪টি নালা পুণর্নিমাণ করেছে কেসিসি। ময়ূর নদসহ সাতটি খাল পুনঃখনন ও ৩২টি নালার সংস্কার চলছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫০২ কোটি টাকা। তবে এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরও নগরের জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কেসিসির কর্মকর্তাদের দাবি, নগরকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করতে নতুন করে পাম্পহাউজ ও স্লুইজগেট নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে কেসিসি। প্রথমপর্যায়ের চলমান ড্রেনেজ প্রকল্পের বাকি চারধাপ এবং পাম্পহাউজ ও স্লুইজগেট নির্মাণ শেষ হলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে রক্ষা মিলবে বলে আশা করছে কেসিসি কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মো. মশিউজ্জামান বলেন, নগরের পানি রূপসা নদীতে গিয়ে পড়ে। রূপসার তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। জোয়ারের সময় বৃষ্টি হলে পানি বের হতে পারে না, উল্টো নদীর পানি নগরে প্রবেশ করে। এজন্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রূপসায় একটি স্লুইসগেট ও পাম্প হাউজ নির্মাণের দরপত্র আহবান করা হয়েছে। পাম্পহাউজ নির্মাণ হলে বৃষ্টির পানি পাম্প করে নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। আর নদীর পানিও নগরে প্রবেশ আটকে দেওয়া হবে। ফলে নগরে আর বৃষ্টির পানি জমবে না।
প্রসঙ্গত, খুলনা শহরের জলাবদ্ধতার বাস্তবতা নিয়ে এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান ১১ নভেম্বর দুপুরে নগরের শহীদ হাদিস পার্কে অনুষ্ঠিত হয়েছে। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ এর উদ্বোধন করেন।