সম্পদের পাহাড় সাবেক কৃষিমন্ত্রীর
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:৪৭:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ৩৯ বার পড়া হয়েছে
সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ মৌলভীবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি আব্দুস শহীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি করে মৌলভীবাজারে চা বাগান দখল করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তিনি নিজ এলাকায় গড়েছেন লুটপাটের বাহিনীও। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, আইনি সহায়তার মাধ্যমে তার দখল করা সম্পদ উদ্ধারের কাজ চলছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চা-বাগান প্রতিষ্ঠার নামে বন বিভাগের জমি দখল, বাগানবাড়ি নির্মাণ, হাইল-হাওরে মৎস্য খামার তৈরিসহ নানাভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েন তিনি। চার একর জমি নিজের মালিকানায় নিয়ে ২০১৮ সালে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশে ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে চা-বাগান গড়ে তোলেন। লাউয়াছড়া উদ্যানের পাঁচ একর পাহাড়ি জমি জোরপূর্বক দখল করে নেন। সরকারি খরচে পুরো চা-বাগানে পল্লী বিদ্যুতের লাইন টেনে বিদ্যুৎ সংযোগ ও পানি সেচের জন্য স্থাপন করেন ১৬টি গভীর নলকূপ।
সরকারি খরচে একাধিক গভীর নলকূপ স্থাপন এবং বিদ্যুতের জন্য আটটি সৌর প্লান্ট নির্মাণ করেন আব্দুস শহীদ। পাশাপাশি শ্রীমঙ্গল বাইক্কাবিলের পাশে প্রায় ১১ একর জমি নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল মৎস্য খামার।
পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে চা-বাগান। বাগানে ১৬টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। এসব গভীর নলকূপের কারণে পাহাড়ি এলাকার লোকজন চাপকলে পানি পাচ্ছেন না। এদিকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাঁচ একর জমি সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখল থেকে মুক্ত করা হয়েছে। বাকিগুলোও দ্রুত উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা।
মৌলভীবাজার বন্য প্রাণী রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, আগে চেষ্টা চালিয়ে জমি উদ্ধার করা না গেলেও এবার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাঁচ একর জমি জবরদখল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর এই জমি উদ্ধার হয়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের এই জমিতে বন্য প্রাণীর ফলমূল খাবার উপযোগী চারা গাছ লাগানো হয়েছে।
মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) এ বি এম মিজানুর রহমান বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে জানান, সাবেক কৃষিমন্ত্রী শহীদের নামে এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদুজ্জামান বলেন, বাগান বাড়ি এবং চা বাগানে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপনের বিষয়টি আমার জানা নেই।
মেয়ের নামে কমলগঞ্জ মাঝেরছড়া এলাকায় কয়েক শ একর টিলা-ভূমি ও জমি কিনেছেন সাবেক এই কৃষিমন্ত্রী। রাজধানীর উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডে বাসা, ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের জগদীশ পুর পেট্রল পাম্প, ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় জমি কিনে ভবন করে ভাড়া হিসেবে দেওয়া আছে তার।
শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়ন দিলবরনগর এলাকায় ৬ একর জমিতে লেবু বাগানে ১১টি ডিপ টিউবওয়েল, সরকারি খরচে এলজিইডি থেকে ব্রিজ, গাইডওয়াল আরসিসি ঢালাই রাস্তা নির্মাণ করেছেন। শ্রীমঙ্গল পৌর শহরের কলেজ রোডে পাঁচতলা ভবনের বারান্দায় সরকারি ডিপ টিউবওয়েল বসিয়েছেন।
মৌলভীবাজার রোড, হাউজিং এস্টেট এলাকায় জমিতে সরকারি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন, কমলগঞ্জ উপজেলা দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন তিন তলা বাসা তৈরি, সরকারি খরচে ডিপ টিউবওয়েল এবং সোলার লাইট স্থাপন করেছেন। নিজ গ্রামের বাড়ির ভেতরে রাস্তায় সরকারি খরচে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে সোলার লাইট স্থাপন ও পুকুর খনন করেছেন। বড় মেয়ে উম্মে ফারজানা ডায়নার স্বামী সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়িতে চড়তেন। মন্ত্রীর ভাই মানিকের নামে রয়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট।
এদিকে, ২০১২ সালে বিধি লঙ্ঘন করে আট কিলোমিটার দীর্ঘ একটি গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের ব্যয় বহন করছে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি। কারণ, ওই পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস জাতীয় সংসদের সরকারি দলের তৎকালীন চিফ হুইপ আব্দুস শহীদের গ্রামের বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।
কোম্পানির বিধি অনুযায়ী, জালালাবাদের গ্যাস সংযোগ পেতে নতুন পাইপলাইন বসানোর দরকার হলে তার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতে হয় গ্রাহককে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই বিধি লঙ্ঘন করেছে কম্পানিটি। চিফ হুইপের একটি অনানুষ্ঠানিক চাহিদাপত্রে (ডিও লেটার) করা আবদার মেটাতে গিয়ে কম্পানিকে ওই বিধি লঙ্ঘন ও প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ টাকার আর্থিক দায় মেনে নিতে হয়।
চিফ হুইপের গ্রামের বাড়ি কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার গ্রামে। জালালাবাদ গ্যাস কম্পানির বিদ্যমান লাইন থেকে ওই গ্রাম পর্যন্ত আট কিলোমিটার নতুন পাইপলাইন স্থাপনে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে। পাইপলাইনটি কমলগঞ্জের দেবীপুর, সিদ্ধেশ্বরপুর, রহিমপুর হয়ে মুন্সিবাজারে চিফ হুইপের বাড়িতে গিয়ে শেষ হয়। কম্পানির করা মাঠ নকশা অনুযায়ী, কমলগঞ্জের আদমপুরে জালালাবাদ গ্যাসের সাবস্টেশন থেকে মুন্সিবাজার গ্রাম পর্যন্ত পাইপলাইন বসিয়ে গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়। সে সময়ে সরেজমিনে গিয়ে ওসব এলাকার প্রায় তিন কিলোমিটারের মধ্যে খুব বেশি জনবসতি চোখে পড়েনি।
কোম্পানি সূত্র জানায়, তৎকালীন সময়ে চিফ হুইপের চাহিদাপত্র পাওয়ার পর কম্পানির পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন পাইপলাইনটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আট কিলোমিটার দীর্ঘ ওই পাইপলাইন স্থাপন করা হলে ৫০-৬০ জন আবাসিক গ্রাহক, ৪-৫ জন বাণিজ্যিক গ্রাহক এবং ২-১টি কুটিরশিল্প গ্যাস-সংযোগের আওতায় আসতে পারে। ফলে পাইপলাইনটির মাধ্যমে গ্যাস সংযোগের আওতা বাড়ানো লাভজনক হবে না।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাইপলাইনটি স্থাপিত হলে প্রায় ২০০ আবাসিক ও ২০ জন বাণিজ্যিক গ্রাহক সংযোগের আওতায় আসবেন। অদূর ভবিষ্যতে গ্রাহকসংখ্যা আরো বাড়বে। ২০১২ সালের ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত কম্পানির পরিচালনা পর্ষদের ৩০৯তম সভায় প্রতিবেদনটি গ্রহণ করা হয় এবং প্রতিবছর গ্রাহকসংখ্যা পাঁচ শতাংশ বাড়বে ধরে নিয়ে আর্থিক বিশ্লেষণী প্রতিবেদন তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সিনিয়র সহসভাপতি জয়নাল চৌধুরী বলেন, ১৬ বছর বিএনপির নির্বাহী কমিটি সদস্য হাজী মুজিবুর রহমান চৌধুরীকে ১৩৪টি মামলা দিয়ে সাবেক কৃষিমন্ত্রী হয়রানি ও নির্যাতন করেছে। তিনি বিগত ১৬ বছর এলাকায় মিটিং ও মিছিল করতে পারেননি। ইফতার মাহফিলে গিয়ে তার বাহিনী হামলা ও ভাঙচুর করেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মৌলভীবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক জহর লাল দত্ত সাবেক এ কৃষিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে তার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
বামফ্রন্টের অন্যতম নেতা বিশ্বজিৎ বলেন, অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাধারণ মানুষ মুখ খুলে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। সাবেক এ মন্ত্রী কমলগঞ্জ শ্রীমঙ্গল উপজেলা পর্যায়ে লুটপাটের এক বাহিনী তৈরি করেছিলেন।
১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রহিমপুর ইউনিয়নের সিদ্ধেশ্বরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুস শহীদ। ১৯৭৩ সালে জেলার কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয়ে যোগদান করে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন। তিনি সাতবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম, ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম, ২০১৮ সালের একাদশ ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার-৪ আসন থেকে জয়লাভ করেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।