ঢাকা ০১:৪৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাগড়াছড়িতে বিচার দাবি নিহতের স্বজনদের

আওয়ামী দুঃশাসন: সাড়ে ১৬ বছরে বিএনপির ১৯ নেতাকর্মীকে হত্যা

বিশেষ প্রতিবেদক
  • সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:০৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪ ৩৮ বার পড়া হয়েছে
বাংলা টাইমস অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৬ বছরের শাসনামলে ৯টি উপজেলায় ১৯ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা। জেলায় আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর হওয়া নির্মম নির্যাতনের চিত্র আজও ভেসে ভেসে আসে। ২০০৮থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাবেক দুই এমপি যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার শাসনামলে ১৯ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং দেড় সহস্ত্রাধিক আহত হয়েছে।

২০০৮সাল থেকে ২০১৪ সালে যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরার ও ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগষ্ট পর্যন্ত কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার টানা প্রায় সাড়ে ১৬ বছর খাগড়াছড়ির জনপদ বিএনপির নেতাকর্মীদের রক্তে লালে লাল হয়েছিল। খাগড়াছড়ি যেন পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপরীতে। কোন কোন হত্যাকান্ডের ঘটনায় সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে পুলিশ ও আওয়ামীলীগ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে মামলা করে। পরে দেওয়া হয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন।

পাশাপাশি বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে অন্তত: দেড় সহস্ত্রাধিক বিএনপির নেতাকর্মী আহত হয়েছে। পুঙ্গত্ব বরণ করেছেন অনেক নেতাকর্মী। সাথে হামলা-মামলাতো ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার।

২০১৫সালের ২২শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মাটিরাঙা উপজেলা কৃষক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম। বাড়ীর পাশে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। মামলা করতে গেলে বাঁধে বিপত্তি। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাদা কাগজে সই নিয়ে নিজেদের মনগড়া মামলা দায়ের করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৃষক দল নেতা নজরুল ইসলাম হত্যাকান্ডের বিচার চান তার পরিবার।

নজরুল ইসলামের মেয়ে শামসুন্নাহার নুপুর বলেন, হত্যাকান্ডের প্রায় ৯বছর পরও তার বাবার হত্যার বিচার পায়নি। হত্যার বিচারের আশায় ঘুরতে ঘুরতে তাদের মা সরিফা বেগম হাসপাতালে মৃত্যু শর্যায়।

নজরুল ইসলামের ছেলে ও মামলার বাদী মো: রাসেল বলেন, তার পিতাকে হত্যার পর লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়েছিল। মামলা করতে গেলে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বাঁধা দেয়। পরে পুলিশ মনগড়া চার্জসীট দাখিল করে। হত্যাকারীরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলা পুনঃতদন্ত ও হত্যাকারীদের বিচার চান নজরুলের পরিবার।

বিরোধী দলের অবরোধ চলাকালে ২০২৩সালের ২০শে নভেম্বর বিকেলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলায় খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা উপজেলা মেরুং উত্তর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি রবিউল ইসলাম গুরতর আহত হয়। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে টানা ২৬দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ১৬ই ডিসেম্বর রাত পৌনে ১১টার দিকে মারা যান।

মাটিরাঙা উপজেলায় শ্রমিক দলের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম হত্যাকান্ড ছিল আরো ভয়ানক ও নির্মম। ২০১০সালের ৩১শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাকে ডেকে নিয়ে মাটিরাঙা উপজেলা পরিষদের সামনে প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে পিটিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগের ৫/৭ জন কর্মী। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সিরাজুল ইসলাম হত্যাকারীদের নাম বলে গেলেও মামলা করতে পারেনি পরিবার। ভয়ভীতি দেখিয়ে সিরাজুল ইসলামের বড় ছেলে আবু ইউছুপ রানার কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে নিজেদের মতো করে মামলা করে পুলিশ। ১৪ বছর ধরে শ্রমিক দল নেতা সিরাজুল আসলাম হত্যাকান্ডের বিচারের বানী নিরবে কাঁদছে। পরিবারের দাবী নতুন করে মামলা তদন্ত ও প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচার।

সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, তার স্বামীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর আগ মহুত্বে স্বামী হত্যাকারীদের নাম বলে গেছে। কিন্তু মামলায় তাদের নাম দিতে পারেনি। ১৪বছর ধরে স্বামী হত্যার বিচারের প্রতীক্ষায় আছি।

সিরাজুল ইসলামের ছেলে ও মামলার বাদী মো: আবু ইউছুফ রানা বলেন, পুলিশ সাদা কাগজে সাক্ষর নিয়ে মামলা করেছে। তদন্তের ৫হত্যাকারীর নাম আসলেও চার্জসীটে আসামী দেখানো হয়েছে মাত্র একজন।

সিরাজুল ইসলামের ছোট ছেলে আসলাম হোসেন বলেন, তার বাবাকে হত্যার পর আওয়ামীলীগ ও পুলিশ তাদের পরিবারকে অনেকটা বন্দি অবস্থায় রেখেছিল। তিনি এখন মামলার পুনঃতদন্ত চান।

২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বিকেলে খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রদলের যুগ্ন সম্পাদক মো: সাহাজ উদ্দিন সাজুকে শহরের লারমা স্কয়ার এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ আটক করে। প্রথমে পিটিয়ি তার হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। গুরতর আহত সাজুকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করা হলে ৮ অক্টোবর সকালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান সাজু।

ছাত্রদল নেতা সাজুর মা আকলিমা আক্তার বলেন, আমার একমাত্র ছেলেকে পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশের হুমকিতে মামলা করতে পারেনি।

ছাত্রদল নেতা সাজুর পিতা মো: আব্দুল্লাহ বলেন, ডিবি পুলিশ আমার ছেলে পিটিয়ে হা-পা ভেঙ্গে হত্যা করেছে। কিন্তু বিচারতো দুরে মামলাও করতে পারেনি। এখন সময় এসেছে, মামলার প্রস্তুুতি নিচ্ছি।

শুধু নজরুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম নয়, মো: সাহাজ উদ্দিন সাজু ও রবিউল ইসলাম নয়,আওয়ামীলীগের সাড়ে ১৬বছরে খাগড়াছড়ি দীঘিনালায় বিএনপির নেতা হাবিবুর রহমান, মজিবুর রহমান, বাদল খান, হারেজ মিয়া, মানিকছড়িতে বিএনপির নেতা ডা: গোফরান মিয়া, মহালছড়িতে বিএনপির নেতা লাল মিয়া, রামগড়ে ছাত্রদল নেতা মো: ওমর ফারুক, ছাত্রদল নেতা মো: শাহ আলম, গুইমারায় ছাত্রদল নেতা রবিউল ইসলাম, ভাইবোনছড়ায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাকিল আহমেদ, খাগড়াছড়ির কুমিল্লা টিলায় যুবদল নেতা শামসুল হক, রামগড়ে যুবদল নেতা মো: আলাউদ্দিন, সমর দাস, লক্ষ্মীছড়িতে যুবদল নেতা মো: মোজাম্মেল হক, জিয়া নগরে কৃষক দলের নেতা মো: আব্দুল্লাহ আওয়ামীলীগের হামলা ও পুলিশের নির্যাতনে নিহত হয়েছেন।

২০০৮সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি সংসদীয় আসনে যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তার পাঁচ বছরের শাসনামলে খাগড়াছড়িতে সব চেয়ে বেশি অর্থাৎ ১০ জন বিএনপির নেতাকর্মী মারা গেছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে এখনো মামলা হয়নি।

অপরদিকে, ২০১৪সালের ৫ জানুয়ারী থেকে পরবর্তি টানা তিনবার বিনা ভোটের নির্বাচনে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নির্বাচিত হন। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার আমলে খাগড়াছড়ি এক ভীভিষাময় জনপদে পরিণত হয়। বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্য, নির্যাতন-নিপিড়ন, হামলা, গায়েবী মামলা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বানিজ্য, নারী কেলেংকারী, মদ-জুয়ার আসড়ে লিপ্ত ছিলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। নানা দুর্নীতি-অনিয়ম করে হাজার কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি। সর্বশেষ হয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি মন্ত্রীও। এখন তিনি অসংখ্য মামলার আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াছেন।

খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ ওয়াদুদ ভূইয়া খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৬ বছরের শাসনামলের নির্মম নির্যাতনে চিত্র তুলে বলেন, ১৯জন নেতাকর্মীকে হত্যা, একজনকে গুম ও দেড় হাজার নেতাকর্মীকে আহত করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকে পঙ্গত্ব বরন করতে হয়েছে। বিএনপি’র নেতাতো কোন সমর্থকও এ জেলায় কেউ ব্যবসা-বানিজ্য করতে পারেনি। চাকুরি পায়নি।

আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৬ বছরে প্রায় ৫০ হাজার নেতাকর্মীর নামে তিন শতাধিক মিথ্যা ও গায়েবী মামলা হয়েছে। কোন নেতাকর্মী বাড়ী-ঘরে থাকতে পারেনি। আদালতের বান্দায় অথবা জঙ্গলে রাত কাটাতে হয়েছে।

নিহত ও আহতসহ ক্ষতিগ্রস্ত বিএনপির নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে ওয়াদুদ ভূইয়া আরো বলেন, প্রত্যেক নিহত ও আহত পরিবারকে প্রতি বছর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে আসছে। খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি তার সামর্থ্যরে মধ্যে কয়েকটি পরিবারকে পুনর্বাসন করেছে। আগামীতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, ২০০৯থেকে ২০২৪পর্যন্ত খাগড়াছড়িতে সকল রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচার হবে। মামলা পুনঃতদন্তের আদালতে নির্দেশনা পেলে পুলিশ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহিৃত করে আইনের আওতায় আনবে ও যারা মামলা করতে পারে তারা মামলা করতে চাইলে পুলিশ সে সব পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করবে।

খাগড়াছড়ি হবে শান্তির জনপদ। প্রত্যেক মানুষের জীবনে, ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তা ও সহাবস্থানের নিশ্চয়তা চায় খাগড়াছড়িবাসী।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

খাগড়াছড়িতে বিচার দাবি নিহতের স্বজনদের

আওয়ামী দুঃশাসন: সাড়ে ১৬ বছরে বিএনপির ১৯ নেতাকর্মীকে হত্যা

সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:০৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৬ বছরের শাসনামলে ৯টি উপজেলায় ১৯ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা। জেলায় আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর হওয়া নির্মম নির্যাতনের চিত্র আজও ভেসে ভেসে আসে। ২০০৮থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাবেক দুই এমপি যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার শাসনামলে ১৯ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং দেড় সহস্ত্রাধিক আহত হয়েছে।

২০০৮সাল থেকে ২০১৪ সালে যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরার ও ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগষ্ট পর্যন্ত কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার টানা প্রায় সাড়ে ১৬ বছর খাগড়াছড়ির জনপদ বিএনপির নেতাকর্মীদের রক্তে লালে লাল হয়েছিল। খাগড়াছড়ি যেন পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপরীতে। কোন কোন হত্যাকান্ডের ঘটনায় সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে পুলিশ ও আওয়ামীলীগ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে মামলা করে। পরে দেওয়া হয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন।

পাশাপাশি বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে অন্তত: দেড় সহস্ত্রাধিক বিএনপির নেতাকর্মী আহত হয়েছে। পুঙ্গত্ব বরণ করেছেন অনেক নেতাকর্মী। সাথে হামলা-মামলাতো ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার।

২০১৫সালের ২২শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মাটিরাঙা উপজেলা কৃষক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম। বাড়ীর পাশে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। মামলা করতে গেলে বাঁধে বিপত্তি। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাদা কাগজে সই নিয়ে নিজেদের মনগড়া মামলা দায়ের করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৃষক দল নেতা নজরুল ইসলাম হত্যাকান্ডের বিচার চান তার পরিবার।

নজরুল ইসলামের মেয়ে শামসুন্নাহার নুপুর বলেন, হত্যাকান্ডের প্রায় ৯বছর পরও তার বাবার হত্যার বিচার পায়নি। হত্যার বিচারের আশায় ঘুরতে ঘুরতে তাদের মা সরিফা বেগম হাসপাতালে মৃত্যু শর্যায়।

নজরুল ইসলামের ছেলে ও মামলার বাদী মো: রাসেল বলেন, তার পিতাকে হত্যার পর লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়েছিল। মামলা করতে গেলে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বাঁধা দেয়। পরে পুলিশ মনগড়া চার্জসীট দাখিল করে। হত্যাকারীরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলা পুনঃতদন্ত ও হত্যাকারীদের বিচার চান নজরুলের পরিবার।

বিরোধী দলের অবরোধ চলাকালে ২০২৩সালের ২০শে নভেম্বর বিকেলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলায় খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা উপজেলা মেরুং উত্তর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি রবিউল ইসলাম গুরতর আহত হয়। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে টানা ২৬দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ১৬ই ডিসেম্বর রাত পৌনে ১১টার দিকে মারা যান।

মাটিরাঙা উপজেলায় শ্রমিক দলের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম হত্যাকান্ড ছিল আরো ভয়ানক ও নির্মম। ২০১০সালের ৩১শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাকে ডেকে নিয়ে মাটিরাঙা উপজেলা পরিষদের সামনে প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে পিটিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগের ৫/৭ জন কর্মী। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সিরাজুল ইসলাম হত্যাকারীদের নাম বলে গেলেও মামলা করতে পারেনি পরিবার। ভয়ভীতি দেখিয়ে সিরাজুল ইসলামের বড় ছেলে আবু ইউছুপ রানার কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে নিজেদের মতো করে মামলা করে পুলিশ। ১৪ বছর ধরে শ্রমিক দল নেতা সিরাজুল আসলাম হত্যাকান্ডের বিচারের বানী নিরবে কাঁদছে। পরিবারের দাবী নতুন করে মামলা তদন্ত ও প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচার।

সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, তার স্বামীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর আগ মহুত্বে স্বামী হত্যাকারীদের নাম বলে গেছে। কিন্তু মামলায় তাদের নাম দিতে পারেনি। ১৪বছর ধরে স্বামী হত্যার বিচারের প্রতীক্ষায় আছি।

সিরাজুল ইসলামের ছেলে ও মামলার বাদী মো: আবু ইউছুফ রানা বলেন, পুলিশ সাদা কাগজে সাক্ষর নিয়ে মামলা করেছে। তদন্তের ৫হত্যাকারীর নাম আসলেও চার্জসীটে আসামী দেখানো হয়েছে মাত্র একজন।

সিরাজুল ইসলামের ছোট ছেলে আসলাম হোসেন বলেন, তার বাবাকে হত্যার পর আওয়ামীলীগ ও পুলিশ তাদের পরিবারকে অনেকটা বন্দি অবস্থায় রেখেছিল। তিনি এখন মামলার পুনঃতদন্ত চান।

২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বিকেলে খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রদলের যুগ্ন সম্পাদক মো: সাহাজ উদ্দিন সাজুকে শহরের লারমা স্কয়ার এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ আটক করে। প্রথমে পিটিয়ি তার হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। গুরতর আহত সাজুকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করা হলে ৮ অক্টোবর সকালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান সাজু।

ছাত্রদল নেতা সাজুর মা আকলিমা আক্তার বলেন, আমার একমাত্র ছেলেকে পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশের হুমকিতে মামলা করতে পারেনি।

ছাত্রদল নেতা সাজুর পিতা মো: আব্দুল্লাহ বলেন, ডিবি পুলিশ আমার ছেলে পিটিয়ে হা-পা ভেঙ্গে হত্যা করেছে। কিন্তু বিচারতো দুরে মামলাও করতে পারেনি। এখন সময় এসেছে, মামলার প্রস্তুুতি নিচ্ছি।

শুধু নজরুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম নয়, মো: সাহাজ উদ্দিন সাজু ও রবিউল ইসলাম নয়,আওয়ামীলীগের সাড়ে ১৬বছরে খাগড়াছড়ি দীঘিনালায় বিএনপির নেতা হাবিবুর রহমান, মজিবুর রহমান, বাদল খান, হারেজ মিয়া, মানিকছড়িতে বিএনপির নেতা ডা: গোফরান মিয়া, মহালছড়িতে বিএনপির নেতা লাল মিয়া, রামগড়ে ছাত্রদল নেতা মো: ওমর ফারুক, ছাত্রদল নেতা মো: শাহ আলম, গুইমারায় ছাত্রদল নেতা রবিউল ইসলাম, ভাইবোনছড়ায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাকিল আহমেদ, খাগড়াছড়ির কুমিল্লা টিলায় যুবদল নেতা শামসুল হক, রামগড়ে যুবদল নেতা মো: আলাউদ্দিন, সমর দাস, লক্ষ্মীছড়িতে যুবদল নেতা মো: মোজাম্মেল হক, জিয়া নগরে কৃষক দলের নেতা মো: আব্দুল্লাহ আওয়ামীলীগের হামলা ও পুলিশের নির্যাতনে নিহত হয়েছেন।

২০০৮সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি সংসদীয় আসনে যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তার পাঁচ বছরের শাসনামলে খাগড়াছড়িতে সব চেয়ে বেশি অর্থাৎ ১০ জন বিএনপির নেতাকর্মী মারা গেছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে এখনো মামলা হয়নি।

অপরদিকে, ২০১৪সালের ৫ জানুয়ারী থেকে পরবর্তি টানা তিনবার বিনা ভোটের নির্বাচনে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নির্বাচিত হন। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার আমলে খাগড়াছড়ি এক ভীভিষাময় জনপদে পরিণত হয়। বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্য, নির্যাতন-নিপিড়ন, হামলা, গায়েবী মামলা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বানিজ্য, নারী কেলেংকারী, মদ-জুয়ার আসড়ে লিপ্ত ছিলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। নানা দুর্নীতি-অনিয়ম করে হাজার কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি। সর্বশেষ হয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি মন্ত্রীও। এখন তিনি অসংখ্য মামলার আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াছেন।

খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ ওয়াদুদ ভূইয়া খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৬ বছরের শাসনামলের নির্মম নির্যাতনে চিত্র তুলে বলেন, ১৯জন নেতাকর্মীকে হত্যা, একজনকে গুম ও দেড় হাজার নেতাকর্মীকে আহত করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকে পঙ্গত্ব বরন করতে হয়েছে। বিএনপি’র নেতাতো কোন সমর্থকও এ জেলায় কেউ ব্যবসা-বানিজ্য করতে পারেনি। চাকুরি পায়নি।

আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৬ বছরে প্রায় ৫০ হাজার নেতাকর্মীর নামে তিন শতাধিক মিথ্যা ও গায়েবী মামলা হয়েছে। কোন নেতাকর্মী বাড়ী-ঘরে থাকতে পারেনি। আদালতের বান্দায় অথবা জঙ্গলে রাত কাটাতে হয়েছে।

নিহত ও আহতসহ ক্ষতিগ্রস্ত বিএনপির নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে ওয়াদুদ ভূইয়া আরো বলেন, প্রত্যেক নিহত ও আহত পরিবারকে প্রতি বছর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে আসছে। খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি তার সামর্থ্যরে মধ্যে কয়েকটি পরিবারকে পুনর্বাসন করেছে। আগামীতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, ২০০৯থেকে ২০২৪পর্যন্ত খাগড়াছড়িতে সকল রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচার হবে। মামলা পুনঃতদন্তের আদালতে নির্দেশনা পেলে পুলিশ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহিৃত করে আইনের আওতায় আনবে ও যারা মামলা করতে পারে তারা মামলা করতে চাইলে পুলিশ সে সব পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করবে।

খাগড়াছড়ি হবে শান্তির জনপদ। প্রত্যেক মানুষের জীবনে, ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তা ও সহাবস্থানের নিশ্চয়তা চায় খাগড়াছড়িবাসী।