আস্থা নেই সর্বজনীন পেনশনে

- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:২৪:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ১৭ বার পড়া হয়েছে
সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রকল্পটির মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা। সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়েছিল চারটি স্কিম নিয়ে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য ‘প্রগতি’, প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’, স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের জন্য ‘সুরক্ষা’ এবং স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ‘সমতা’। গত এক বছরে প্রবাস স্কিমে নিবন্ধনের কোটা এক হাজারও পূরণ হয়নি। তবে আগে এনআইডির প্রয়োজন হলেও এখন পাসপোর্টের তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করা যাচ্ছে। প্রবাসীরা বলছেন, যথাযথ প্রচার ও আস্থার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে এই প্রকল্প।
বিগত সরকারের গৃহীত এ স্কিম এখন গ্রাহকদের অভাবে অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। এক সময় প্রতিদিন যেখানে সর্বজনীন পেনশন স্কিম ৪-৫ হাজার মানুষ এনরলমেন্ট বা নিবন্ধন করত, এখন এক বছরে ব্যবধানে তা কমে দাঁড়িয়েছে চার-পাঁচ জনে। এমনকি কোনো কোনো দিন একজন গ্রাহকও এ স্কিমের সাথে যুক্ত হচ্ছেন না। আবার যারা মাসে মাসে কিস্তির টাকা দিতেন, আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তাদের অধিকাংশই আর চাঁদাও দিচ্ছেন না। এ চাঁদা না দেয়ার হার অনেক বলে জানা গেছে। এর অন্যতম কারণ এ স্কিমে সাথে সরকারি, স্বায়ত্তশাষিত এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের জন্য নির্ধারিত ‘প্রত্যয়’ স্কিমটি ব্যাপক সমালোচনা ও অন্দোলনের মুখে পতিত সরকার গত আগস্ট মাসে সার্কুলার জারি করে প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে পুরো স্কিম এখন বেসরকারি খাত-নির্ভর হয়ে পড়েছে। এ কারণে স্কিমের সফলতাও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অনেকে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে প্রশ্নবিদ্ধ এ স্কিমটি চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
কারণ এ স্কিমটি চালানোর জন্য সরকারকে প্রতি মাসে একটা মোটা অঙ্কের অর্থব্যয় করতে হচ্ছে। গত জুন পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন মাত্র ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৩ জন গ্রাহক। আমার বিবেচনায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম সরকার এবং গ্রাহক দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক। সরকার এখন শুধু টাকা পাবে। টাকা শোধ করার জন্য সময় পাবে সর্বোচ্চ ৪২ বছর। এই সময়ে পেনশন স্কিমের টাকা বিনিয়োগ করে সরকার আয় করতে পারবে। যে আয়ে পরে পেনশন শোধ করবে।
এদিকে এ স্কিমের সাথে গ্রাহক যুক্ত হোন বা না হোন, স্কিম পরিচালনার জন্য গঠিত ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঠিকই বহন করতে হচ্ছে। তাদের জন্য মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয় বলে জানা গেছে। ফলে পুরো কর্তৃপক্ষই এখন একটি ‘শ্বেত হস্তিতে’ পরিণত হতে চলেছে। কারণ কর্তৃপক্ষের এক নির্বাহী চেয়ারম্যানের বেতনই সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এর সাথে যোগ হচ্ছে সার্বক্ষণিক ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা এবং প্রকৃত ব্যয় অনুযায়ী টেলিফোন ও মোবাইল সুবিধা।
একইভাবে কর্তৃপক্ষের সদস্যদের বেতন নির্ধারিত রয়েছে তিন লাখ টাকা। সাথে সার্বক্ষণিক ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা এবং প্রকৃত ব্যয় অনুযায়ী টেলিফোন ও মোবাইল সুবিধা। প্রতি মাসে তারা এ অর্থ তুলে নিচ্ছেন। এ বাস্তবতায় কাল সোমবার ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের গভর্নিং কাউন্সিলের অনুষ্ঠিত সভা আহবান করা হয়েছে। পদাধিকার বলে এ কাউন্সিলের সভায় সভাপত্বি করার কথা রয়েছে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের।
সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ে বিকেলে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে অর্থ বিভাগের এক সূত্র জানায়, কালকের সভায় পেনশন স্কিমের বর্তমান অবস্থা অর্থ উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরা হবে। তবে পেনশন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সভায় স্কিমের বর্তমান দুরবস্থার কথা উপদেষ্টার কাছে সত্যিই তুলে ধরা হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। কারণ গত মাসেও অর্থ উপদেষ্টার কাছে স্কিম বিষয়ে অবহিতকরণ সভায় বিষয়টি তুলে ধরা হয়। কিন্তু সেখানে পেনশন স্কিমের সব তথ্য তুলে ধরা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্কিমের হালনাগাদ তথ্য জানতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো: গোলাম মোস্তফা জানান, গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত পেনশন স্কিমে মোট নিবন্ধনধারী সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৭২ হাজার ৩৭১ জন। এখন পর্যন্ত এদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে পাওয়া গেছে ১৩০ কোটি ৩৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এ অর্থ সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। গত ৫ আগস্টের সাথে এ কর্মসূচিতে প্রতিদিন ৪-৫ হাজার মানুষ নিবন্ধন করত। বর্তমানে এর পরিমাণ ৪০-৫০ জনে নেমে এসেছে। কোনো কোনো দিন ৫ জনেরও বেশি হয় না।
তথ্য মতে, চারটি স্কিমের মধ্যে দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসরত ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত সমতায় সবচেয়ে বেশি মানুষ নিবন্ধন করেছেন। এর সংখ্যা দুই লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৪ জন। এরপর সুরক্ষা স্কিমের নিবন্ধনের সংখ্যা ৬৩ হাজার ১২৫ জন, প্রগতিতে ২২ হাজার ৩৩২ জন এবং বিদেশীদের জন্য নির্ধারিত প্রবাসে মাত্র ৮৯৪ জন নিবন্ধন করেছেন। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের কারণে স্কিমে অংশগ্রহণের সংখ্যা কমেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যদি রোড শো করা যায়, তবে ভবিষ্যতে নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়বে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার আশায় বিগত হাসিনা সরকার এ স্কিমটি চালু করে। সমতা, সুরক্ষা, প্রগতি ও প্রবাস- এ চারটি স্কিমের মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরু হয়। পরে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নতুন করে যুক্ত করা হয় ‘প্রত্যয় স্কিম’। এ স্কিমে শুধুমাত্র সব স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী চলতি ২০২৪ সালে ১ জুলাই তারিখ ও তৎপরবর্তী সময়ে নতুন যোগদান করবেন, তাদেরকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে গত আগস্টে পুরো প্রত্যয় স্কিম বাতিল করে দেয়া হয়।
গত ২ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ মর্মে জানানো যাচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়, স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রত্যয় স্কিমসহ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে।