ঢাকা ০৮:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব চিংড়িতে, রপ্তানিতেও ধাক্কা

খুলনা প্রতিনিধি
  • সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:১০:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫ ৪২ বার পড়া হয়েছে
বাংলা টাইমস অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশের খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি চাষে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন, পানির মানের অবনতি, এবং ভাইরাস সংক্রমণের মতো চ্যালেঞ্জ চিংড়ি চাষকে সংকটময় অবস্থায় ফেলছে। এ শিল্পে তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংকট শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে না, বরং বৈশ্বিক রপ্তানির ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

রপ্তানিকারকরা জানান, দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান ‘সাদাসোনা’ নামে পরিচিত চিংড়িশিল্পের। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই উৎপাদিত হয় খুলনা অঞ্চলে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েক হাজার মানুষের আয়ের উৎস চিংড়িচাষ। এ অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ ইউরোপসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে রপ্তানি হয়। তবে বিগত কয়েক বছর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে চিংড়ি উৎপাদনে।

চিংড়িচাষিরা বলছেন, গত কয়েক বছর প্রধানত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিকদুর্যোগ, রোগ-বালাইসহ নানাবিধ কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প চরমসংকটে। নদ-নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। জোয়ারের স্বাভাবিক গতি কমছে। পানিতে লবণের মাত্রা কম দেখা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে পানির উষ্ণতা বাড়ছে। ফলে পানিতে তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে বাড়ছে রোগবালাই, চিংড়ির মৃত্যু হার বাড়ছে।

একইসাথে চিংড়ির পোনা, খাদ্য, শ্রমিকের মজুরি, পরিবহনসহ সবখরচ বাড়লেও উৎপাদিত চিংড়ির দাম সেভাবে বাড়েনি। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন মূলধনই টিকছে না প্রান্তিকচাষিদের। ঋণ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত তারা। ফলে ‘জীবিকা নিয়ে সংকট’র চিংড়িচাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই।

চিংড়িচাষিদের অভিযোগ, চিংড়িশিল্প পুরোটাই বেসরকারি সিন্ডিকেটের দখলে। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কারসাজি করে চাষিদের কমদামে চিংড়ি বিক্রিতে বাধ্য করে। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন তারা। এছাড়া একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চিংড়ির ওজন বাড়াতে চিংড়ির ভেতরে বিভিন্ন অপদ্রব্য ঢুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পাঠান। আর এর দোষ চাপানো হয় চাষিদের উপর। সা¤প্রতিক সময়ে এ অপচেষ্টা ব্যাপকহারে বেড়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অভিযানে তা ধরাও পড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বেশি প্রভাব রয়েছে খুলনার সর্বদক্ষিণের সুন্দরবনঘেরা উপজেলা কয়রায়। এ উপজেলার গাতিরঘেরি গ্রামের কৃষক দেবাশীষ মন্ডল বলেন, চিংড়ি চাষে এখন আগের মতো লাভ হয় না। ঘেরে প্রতিবছর ভাইরাসে দুইবার চিংড়ি মরে। উৎপাদনও ভালো নয়। সেই সঙ্গে দামেরও হেরফের রয়েছে। আবার চিংড়ির ঘেরে নদীর পানি প্রবেশের কারণে বেড়িবাঁধ ভাঙে। এ কারণে চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর কুমার সরকার জানান, চিংড়ি চাষে এর পোনা খুবই স্পর্শকাতর। এর জন্য পানি, খাবার, পরিবেশ ও তাপমাত্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখন আগের মতো নদ-নদীর প্রাকৃতিক চিংড়ির পোনা মেলে না। অল্প কিছু পাওয়া গেলেও ঘেরে ছাড়ার পর অল্প গভীরে পানির তাপমাত্রা সহনীয় না থাকায় সেগুলো টিকছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে ভরাট হওয়ায় পানির উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সনাতন পদ্ধতিতে চাষে অভ্যস্ত হওয়ায় চাষিদেরও অজ্ঞতা রয়েছে।

খুলনার পাইকগাছা এলাকার চিংড়ি চাষি গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, জানুয়ারি মাস থেকে এই অঞ্চলের নদ-নদীতে লবণাক্ত পানি চলে আসে। পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকছে, আবার প্রয়োজনের সময় কমে যাচ্ছে। সাধারণত মে-জুন মাসে পানিতে লবণের মাত্রা ১৬-১৮ পিপিটি থাকে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ৮-১০ পিপিটিতে নেমে আসে। বৃষ্টি স্বাভাবিক না থাকায় লবণের মাত্রায় হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটছে। আগে সনাতন পদ্ধতির ঘেরে হ্যাচারির পোনা ছাড়ার পর ৬০-৭০ শতাংশ টিকতো। এখন ১৫-২০ শতাংশ পোনাও বাঁচে না। এতে চিংড়ি চাষে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের।

রিপন বলেন, আগে জোয়ারের পানি চিংড়িঘেরে ঢোকানোর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা আসতো। কিন্তু নদ- নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে এখন পোনা আসে না। পানির এ অবস্থার কারণে মাটির তারতম্যে পরিবর্তন হয়েছে হয়তো। যে কারণে চিংড়িচাষে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সা¤প্রতিক বছরগুলোয় ফলে মাঠপর্যায়ে চিংড়িচাষে অনীহা বাড়ছে চাষিদের। এ অবস্থায় কেউ কেউ চিংড়ি ছেড়ে সাদা মাছ চাষ করছেন।

উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক জানান, এলাকাটি তীব্র লবণাক্ত জলাভ‚মি। এ এলাকার কৃষকরা চিংড়ি চাষে আগে বেশি আগ্রহী ছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে বাগদা চিংড়িতে রোগবালাইসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন চাষিরা। তবে আমরা চেষ্টা করছি চাষিদের সহযোগিতা দিয়ে উৎপাদন বাড়াতে। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নতুন ও পরিবেশবান্ধব চাষপদ্ধতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন মৎস্য দপ্তর।

খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফারহানা তাসলিমা জানান, অল্পজায়গায় বেশি চিংড়ি উৎপাদনের জন্য চাষিদের প্রশিক্ষিত এবং পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে চাষিদের ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ক্লাস্টার ও সিনোবায়োটিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে এরই মধ্যে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি বহিঃবিশ্বে ভেনামির চাহিদা থাকায় অনেকেই এতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বন্ধে নজরদারি বাড়ানোসহ অভিযান পরিচালনার কথাও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স আ্যসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সাবেক সহ-সভাপতি হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘৬০’র দশকে দেশে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে এটি শিল্প হয়ে ওঠে। গুণগত মানের কারণে ৮০’র দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত বাগদা চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই উৎপাদিত হয় খুলনা অঞ্চলে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েক হাজার মানুষের আয়ের উৎস চিংড়িচাষ। এ অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ ইউরোপসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে। তবে চিংড়ির বিশ্ববাজার এখন ভেনামির দখলে। বিশ্ববাজারে বাগদা বা গলদা চিংড়ির আর আগের মতো চাহিদা কম। এ কারণে আমাদের ভেনামি চিংড়ি চাষে জোর দেওয়া দরকার।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সহকারী আবহাওয়াবিদ মিজানুর রহমান বলেন, বর্ষাকালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। এছাড়া কোনো বছর অতিবৃষ্টি, কখনও অনাবৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ ও ২০২২ সালে বৃষ্টিপাত অনেক কম ছিল। আবার ২০২১, ২০২৩ ও চলতি বছরে বৃষ্টিপাত বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এমন হচ্ছে।

তবে জলাভ‚মি কমে যাওয়ার বিষয়টি প্রাকৃতিক এ কারণকে আরো প্রকট করে তোলে। গত কয়েক দশকে এ অঞ্চলে জলাভূমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে জলাভ‚মি থাকলে সেখানকার পানি অধিক তাপ বা শৈত্যকে শোষণ করে আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারত। কিন্তু এখানে জলাভূমির পরিমাণ দিনদিন কমতে থাকায় শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমেই জনজীবনে পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় বলেন তিনি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সিথ্রিএস) বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০২৪ সাল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। যার গড় তাপমাত্রা শিল্প–পূর্ব সময়ের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল। তাপমাত্রা নথিভুক্ত করার পর থেকে ২০২৪ সালটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, যা আধুনিক যুগের মানুষ আগে কখনো অনুভব করেনি।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, খুলনা অঞ্চলে ৪৮টি চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, এক হাজার ৫৯১টি ডিপো ও কালেকশন সেন্টার রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক লাখ ২৬ হাজার ৫৩৯টি খামারে গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ৫১ হাজার ১১৬ মেট্রিক টন এবং এক লাখ ১২ হাজার ৪৫০টি বাগদা খামারে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ৫২ হাজার ৪৭২ মেট্রিন টন। এই সময়ে আধানিবিড় ১৫২টি খামারে উৎপাদন ছিল দুই হাজার ২৩৩ মেট্রিক টন। আর একটি খামারে ভেনামি হয়েছে ১৩ মেট্রিন টন।

খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৪৫১ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল, যা থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ১৯ হাজার ৯০৫ মেট্রিক টন, আয় ছিল দুই হাজার ৪১২ কোটি টাকা

এক বছর আগে সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পটির মাধ্যমে খুলনা ও বাগেরহাটের ঘেরে সিনোবায়োটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিংড়ি উৎপাদনের গবেষণায় আশাব্যঞ্জক সফলতা এসেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

ওই প্রকল্পের উপপরিচালক সরোজ কুমার মিস্ত্রী জানান, সিনোবায়োটিক প্রযুক্তি বিশেষ উপায়ে তৈরি প্রিবায়োটিক ও প্রোবায়োটিকের সংমিশ্রণ-যা খাদ্যের সঙ্গে চিংড়িকে খাওয়ানো হয়। পাশাপাশি চিংড়ি খামারের পানিতেও প্রয়োগ করা হয়। এটি ব্যবহারের ফলে চিংড়ি চাষের পরিবেশ উন্নত হয়, ক্ষতিকর রোগজীবাণু মারা যায় এবং পানির গুণগত মান বজায় থাকে। একইসাথে চিংড়ির অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন বাড়ে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব চিংড়িতে, রপ্তানিতেও ধাক্কা

সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:১০:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশের খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি চাষে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন, পানির মানের অবনতি, এবং ভাইরাস সংক্রমণের মতো চ্যালেঞ্জ চিংড়ি চাষকে সংকটময় অবস্থায় ফেলছে। এ শিল্পে তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংকট শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে না, বরং বৈশ্বিক রপ্তানির ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

রপ্তানিকারকরা জানান, দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান ‘সাদাসোনা’ নামে পরিচিত চিংড়িশিল্পের। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই উৎপাদিত হয় খুলনা অঞ্চলে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েক হাজার মানুষের আয়ের উৎস চিংড়িচাষ। এ অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ ইউরোপসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে রপ্তানি হয়। তবে বিগত কয়েক বছর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে চিংড়ি উৎপাদনে।

চিংড়িচাষিরা বলছেন, গত কয়েক বছর প্রধানত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিকদুর্যোগ, রোগ-বালাইসহ নানাবিধ কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প চরমসংকটে। নদ-নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। জোয়ারের স্বাভাবিক গতি কমছে। পানিতে লবণের মাত্রা কম দেখা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে পানির উষ্ণতা বাড়ছে। ফলে পানিতে তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে বাড়ছে রোগবালাই, চিংড়ির মৃত্যু হার বাড়ছে।

একইসাথে চিংড়ির পোনা, খাদ্য, শ্রমিকের মজুরি, পরিবহনসহ সবখরচ বাড়লেও উৎপাদিত চিংড়ির দাম সেভাবে বাড়েনি। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন মূলধনই টিকছে না প্রান্তিকচাষিদের। ঋণ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত তারা। ফলে ‘জীবিকা নিয়ে সংকট’র চিংড়িচাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই।

চিংড়িচাষিদের অভিযোগ, চিংড়িশিল্প পুরোটাই বেসরকারি সিন্ডিকেটের দখলে। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কারসাজি করে চাষিদের কমদামে চিংড়ি বিক্রিতে বাধ্য করে। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন তারা। এছাড়া একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চিংড়ির ওজন বাড়াতে চিংড়ির ভেতরে বিভিন্ন অপদ্রব্য ঢুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পাঠান। আর এর দোষ চাপানো হয় চাষিদের উপর। সা¤প্রতিক সময়ে এ অপচেষ্টা ব্যাপকহারে বেড়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অভিযানে তা ধরাও পড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বেশি প্রভাব রয়েছে খুলনার সর্বদক্ষিণের সুন্দরবনঘেরা উপজেলা কয়রায়। এ উপজেলার গাতিরঘেরি গ্রামের কৃষক দেবাশীষ মন্ডল বলেন, চিংড়ি চাষে এখন আগের মতো লাভ হয় না। ঘেরে প্রতিবছর ভাইরাসে দুইবার চিংড়ি মরে। উৎপাদনও ভালো নয়। সেই সঙ্গে দামেরও হেরফের রয়েছে। আবার চিংড়ির ঘেরে নদীর পানি প্রবেশের কারণে বেড়িবাঁধ ভাঙে। এ কারণে চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর কুমার সরকার জানান, চিংড়ি চাষে এর পোনা খুবই স্পর্শকাতর। এর জন্য পানি, খাবার, পরিবেশ ও তাপমাত্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখন আগের মতো নদ-নদীর প্রাকৃতিক চিংড়ির পোনা মেলে না। অল্প কিছু পাওয়া গেলেও ঘেরে ছাড়ার পর অল্প গভীরে পানির তাপমাত্রা সহনীয় না থাকায় সেগুলো টিকছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে ভরাট হওয়ায় পানির উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সনাতন পদ্ধতিতে চাষে অভ্যস্ত হওয়ায় চাষিদেরও অজ্ঞতা রয়েছে।

খুলনার পাইকগাছা এলাকার চিংড়ি চাষি গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, জানুয়ারি মাস থেকে এই অঞ্চলের নদ-নদীতে লবণাক্ত পানি চলে আসে। পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকছে, আবার প্রয়োজনের সময় কমে যাচ্ছে। সাধারণত মে-জুন মাসে পানিতে লবণের মাত্রা ১৬-১৮ পিপিটি থাকে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ৮-১০ পিপিটিতে নেমে আসে। বৃষ্টি স্বাভাবিক না থাকায় লবণের মাত্রায় হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটছে। আগে সনাতন পদ্ধতির ঘেরে হ্যাচারির পোনা ছাড়ার পর ৬০-৭০ শতাংশ টিকতো। এখন ১৫-২০ শতাংশ পোনাও বাঁচে না। এতে চিংড়ি চাষে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের।

রিপন বলেন, আগে জোয়ারের পানি চিংড়িঘেরে ঢোকানোর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা আসতো। কিন্তু নদ- নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে এখন পোনা আসে না। পানির এ অবস্থার কারণে মাটির তারতম্যে পরিবর্তন হয়েছে হয়তো। যে কারণে চিংড়িচাষে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সা¤প্রতিক বছরগুলোয় ফলে মাঠপর্যায়ে চিংড়িচাষে অনীহা বাড়ছে চাষিদের। এ অবস্থায় কেউ কেউ চিংড়ি ছেড়ে সাদা মাছ চাষ করছেন।

উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক জানান, এলাকাটি তীব্র লবণাক্ত জলাভ‚মি। এ এলাকার কৃষকরা চিংড়ি চাষে আগে বেশি আগ্রহী ছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে বাগদা চিংড়িতে রোগবালাইসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন চাষিরা। তবে আমরা চেষ্টা করছি চাষিদের সহযোগিতা দিয়ে উৎপাদন বাড়াতে। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নতুন ও পরিবেশবান্ধব চাষপদ্ধতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন মৎস্য দপ্তর।

খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফারহানা তাসলিমা জানান, অল্পজায়গায় বেশি চিংড়ি উৎপাদনের জন্য চাষিদের প্রশিক্ষিত এবং পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে চাষিদের ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ক্লাস্টার ও সিনোবায়োটিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে এরই মধ্যে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি বহিঃবিশ্বে ভেনামির চাহিদা থাকায় অনেকেই এতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বন্ধে নজরদারি বাড়ানোসহ অভিযান পরিচালনার কথাও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স আ্যসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সাবেক সহ-সভাপতি হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘৬০’র দশকে দেশে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে এটি শিল্প হয়ে ওঠে। গুণগত মানের কারণে ৮০’র দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত বাগদা চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই উৎপাদিত হয় খুলনা অঞ্চলে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েক হাজার মানুষের আয়ের উৎস চিংড়িচাষ। এ অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ ইউরোপসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে। তবে চিংড়ির বিশ্ববাজার এখন ভেনামির দখলে। বিশ্ববাজারে বাগদা বা গলদা চিংড়ির আর আগের মতো চাহিদা কম। এ কারণে আমাদের ভেনামি চিংড়ি চাষে জোর দেওয়া দরকার।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সহকারী আবহাওয়াবিদ মিজানুর রহমান বলেন, বর্ষাকালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। এছাড়া কোনো বছর অতিবৃষ্টি, কখনও অনাবৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ ও ২০২২ সালে বৃষ্টিপাত অনেক কম ছিল। আবার ২০২১, ২০২৩ ও চলতি বছরে বৃষ্টিপাত বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এমন হচ্ছে।

তবে জলাভ‚মি কমে যাওয়ার বিষয়টি প্রাকৃতিক এ কারণকে আরো প্রকট করে তোলে। গত কয়েক দশকে এ অঞ্চলে জলাভূমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে জলাভ‚মি থাকলে সেখানকার পানি অধিক তাপ বা শৈত্যকে শোষণ করে আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারত। কিন্তু এখানে জলাভূমির পরিমাণ দিনদিন কমতে থাকায় শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমেই জনজীবনে পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় বলেন তিনি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সিথ্রিএস) বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০২৪ সাল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। যার গড় তাপমাত্রা শিল্প–পূর্ব সময়ের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল। তাপমাত্রা নথিভুক্ত করার পর থেকে ২০২৪ সালটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, যা আধুনিক যুগের মানুষ আগে কখনো অনুভব করেনি।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, খুলনা অঞ্চলে ৪৮টি চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, এক হাজার ৫৯১টি ডিপো ও কালেকশন সেন্টার রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক লাখ ২৬ হাজার ৫৩৯টি খামারে গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ৫১ হাজার ১১৬ মেট্রিক টন এবং এক লাখ ১২ হাজার ৪৫০টি বাগদা খামারে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ৫২ হাজার ৪৭২ মেট্রিন টন। এই সময়ে আধানিবিড় ১৫২টি খামারে উৎপাদন ছিল দুই হাজার ২৩৩ মেট্রিক টন। আর একটি খামারে ভেনামি হয়েছে ১৩ মেট্রিন টন।

খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৪৫১ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল, যা থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ১৯ হাজার ৯০৫ মেট্রিক টন, আয় ছিল দুই হাজার ৪১২ কোটি টাকা

এক বছর আগে সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পটির মাধ্যমে খুলনা ও বাগেরহাটের ঘেরে সিনোবায়োটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিংড়ি উৎপাদনের গবেষণায় আশাব্যঞ্জক সফলতা এসেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

ওই প্রকল্পের উপপরিচালক সরোজ কুমার মিস্ত্রী জানান, সিনোবায়োটিক প্রযুক্তি বিশেষ উপায়ে তৈরি প্রিবায়োটিক ও প্রোবায়োটিকের সংমিশ্রণ-যা খাদ্যের সঙ্গে চিংড়িকে খাওয়ানো হয়। পাশাপাশি চিংড়ি খামারের পানিতেও প্রয়োগ করা হয়। এটি ব্যবহারের ফলে চিংড়ি চাষের পরিবেশ উন্নত হয়, ক্ষতিকর রোগজীবাণু মারা যায় এবং পানির গুণগত মান বজায় থাকে। একইসাথে চিংড়ির অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন বাড়ে।