ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা রুটে বেড়েছে স্বর্ণ চোরাচালান
স্বর্ণ পাচারে কৌশল বদল, যাত্রীবাহী বাসে বহন
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:২০:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩৮ বার পড়া হয়েছে
ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে খুলনা অঞ্চল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রমতে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে অবৈধ স্বর্ণ, যা খুলনা হয়ে চলে যায় সাতক্ষীরায়। সেখান থেকে পাচার হয় ভারতে। দেশি ও আন্তর্জাতিক একটি শক্তিশালী পাচারকারীচক্র এ পথকে স্বর্ণ পাচারের নিরাপদ হিসেবে ব্যবহার করছে দীর্ঘদিন ধরে। এর সঙ্গে দেশের কতিপয় প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধিরা জড়িত। যারা বরাবরই থাকেন আড়ালে।
আবার কখনও ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে খুলনা হয়ে যশোর, ঝিনাইদহ, ও চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন সীমান্তপথ দিয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে স্বর্ণ। গত ৮ ডিসেম্বর দুপুরে চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সড়কের ডুগডুগি পশুহাটের নিকট হতে ৯টি স্বর্ণের বারসহ রুহুল আমীন (২১) নামের এক পাচারকারীকে আটক করে বিজিবি। আটক স্বর্ণ পাচারকারী দর্শনা পুরাতন বাজারের মোটরসাইকেল মেকানিক রফিকুল ইসলামের ছেলে।
একইদিন রাত ৪টার দিকে সাতক্ষীরা বিজিবি সদস্যরা সদর উপজেলার হরিশপুর গ্রামের পাকা রাস্তার উপর থেকে রুহুল আমিন নামে একজনকে ২৩৩ গ্রাম ২৬৯ মিলিগ্রাম ওজনের ২ পিস স্বর্ণের বারসহ আটক করে। তিনি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হরিশপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে। রুহুল আমিন পায়ুপথ এ স্বর্ণ বহন করছিলেন।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) সূত্রে জানা গেছে, গত ২ ডিসেম্বর ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের সাচিবুনিয়া মোড় থেকে কোমরে বেল্টে স্বর্ণের বকলেসসহ রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার মহব্বতপাড়া এলাকার বাবলু ধর ও চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার আজাদী বাজার বাণিকপাড়া এলাকার রতন মানিকের ছেলে নয়ন মানিককে আটক করে লবণচরা থানা পুলিশ।
পুলিশ জানায়, ওইদিন সকালে ইমাদ পরিবহনের একটি গাড়ি চট্টগ্রাম থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশে যাচ্ছিল। বাসটি সাচিবুনিয়া বিশ্বরোড মোড়ে থামলে তারা সেখানে নামেন। তাদের আচরণে সন্দেহ হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে তারা স্বর্ণ পাচারের ব্যাপার অস্বীকার করেন। পরে এক্স-রে করার কথা বললে তারা, তাদের কাছে স্বর্ণ রয়েছে বলে স্বীকার করেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি স্বর্ণের বকলেস ও একটি ব্রেসলেট উদ্ধার করা হয়। যার ওজন ৫০ ভরির ও বেশি। এগুলো ভারতে পাচারে চট্টগ্রাম থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে নেওয়া হচ্ছিল।
এর ১৮ দিন আগে ১৩ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের একইস্থানে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সাতক্ষীরাগামী একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে আবদুল আউয়াল নামের এক যুবককে আটক করে পুলিশ। থানায় নিয়ে তার দেহ তল্লাশি করে কিছুই পাওয়া যায় না। পরে নগরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্সরে করা হলে তার পেটের মধ্যে দেখা মেলে স্বর্ণের বার। পরে বিশেষ কায়দায় পরপর আটটি বার বের করে দেন আউয়াল। এর আগে গত ৩০ অক্টোবর একইস্থান থেকে ৪ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।
শুধু এ ঘটনাই নয়, কেএমপি সূত্র বলছে, ২০১৩ সালে ৫ অক্টোবর ৯ দশমিক ১১ বর্গ কিলোমিটার আয়াতন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত খুলনা নগরের লবণচরা থানা। এ থানার অংশেই ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা ও ঢাকা-খুলনা-যশোর মহাসড়ক। গত দুবছরে পাচারের সময় খুলনা লবণচরা থানা এলাকা থেকে নয়টি অভিযানে গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে ৫৬টি স্বর্ণের বার, দুটি স্বর্ণের বেল্ট বকলেস এবং একটি বালা উদ্ধার করে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশ। এ সময় আটক করা হয়েছে ১২ পাচারকারীকে। উদ্ধার করা প্রায় সাড়ে ৭ কেজি ওজনের স্বর্ণের দাম ৬ কোটি ১২ লাখ টাকার বেশি।
তবে অভিযোগ রয়েছে, যে পরিমাণ স্বর্ণ সোনা আটক হয়, এর চেয়ে পাচার হয় অনেক বেশি। মাঝেমধ্যে দুই-একটি স্বর্ণের চালান ও বাহক আটক হলেও, ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূল হোতারা। আর মামলার রায় হলে সাজা হয় শুধু তাদের। এসব অপরাধে আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যও জড়িয়ে পড়ছেন।
লবণচরা থানার ইনসপেক্টর (তদন্ত) ইউসুফ আলী বলেন, খুলনা অঞ্চলের সীমান্তপথ স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা স্বর্ণ ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে সাতক্ষীরা ও যশোর অঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় ভারতে। স্বর্ণ পাচারকারীরা ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে যাত্রীবাহী বাস বা পরিবহনে যাতায়াত করে থাকেন। পাচারে এখন পায়ুপথ, জুতার তলা, বেল্টের বকলেসসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে পাচারকারীরা।
লবণচরা থানার ওসি মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, স্বর্ণের চালান মূলত ঢাকা থেকেই বেশি আসে খুলনা অঞ্চলে। পাচারে বহুবার হাতবদল হয়। ফলে মূলহোতা শনাক্ত মুশকিল হয়ে পড়ে। তাদের নাম-পরিচয় শনাক্ত করাও কষ্টসাধ্য। তবে চোরাচালান আটকের পর মামলা হয়। মামলার পর চোরাকারবারে যাদের সংশ্লিষ্টতা ও নাম ঠিকানা পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়।
ওসি তৌহিদুজ্জামান আরও বলেন, ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের লবণচরা থানা এলাকায় পরপর কয়েকটি স্বর্ণের চালান ধরা পড়ার পর পুলিশ আরও সক্রিয় হয়েছে। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের খুঁজে বের করা এবং গ্রেপ্তারে প্রচেষ্টা চলছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে ভারত অনেকটাই কঠোর। এ কারণে প্রচুর চাহিদা থাকার পরও দেশটিতে বৈধপথে স্বর্ণের জোগান কম। চোরাচালানের মাধ্যমেই ভারতে প্রতিবছর প্রচুর স্বর্ণ যায়। যার একটি পথ হলো বাংলাদেশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, চোরাকারবারীরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের চালানগুলো দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী হয়ে দেশে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে বিমানবন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে সেগুলো বাইরে আনা হয়। আর তা ভারতে পাচারে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তপথ ব্যবহার করে চোরাকারবারীরা।