শ্রীমঙ্গলে গ্রেপ্তার আতংকে সাংবাদিকরা, প্রেসক্লাবের নিন্দা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১০:১৩:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ৭ বার পড়া হয়েছে
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছেন বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা। এই মামলায় শুধু সাংবাদিক নন রেয়েছেন শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষও। মামলার আসামী মোট ৫৭ জন। আর এই মামলার আসামী হয়ে কেউ দিতে পারেননি ফাইনাল পরীক্ষা, কেউ বিদেশে গিয়ে গ্রেপ্তারের ভয়ে ফিরতে পারছেন না দেশে। অনেকে খোঁজ নিতে পারছেন না পরিবার পরিজনের। অনেকে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি হওয়ায় তাদের পরিবার মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। এতে শ্রীমঙ্গলের অধিকাংশ গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাগত কর্মকান্ডও মূখ থুবরে পড়েছে। এ মামলায় ইতিমধ্যে আরটিভি ও আমাদের সময় এর মৌলভীবাজার প্রতিনিধি চৌধুরী ভাস্কর হোমকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
বিগত২০২০ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করে গত ১৮ নভেম্বর এই মামলাটি করেছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাসিন্দা বর্তমানে আমেরিকার প্রবাসী শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের বহিষ্কৃত সদস্য এম ইদ্রিছ আলী।
পুলিশ মামলাটি রেকর্ড করেছে বিস্ফোরক আইনে। যেখানে বাদী উল্লেখ করেন আসামীরা ২০২০ সালের ২১ জুন কলেজ রোডস্থ শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবে ককটেল ফাটিয়েছেন ও গুলি করেছেন। তিনিসহ সাক্ষীরা পেসেজের দরজাদিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। পরে প্রেসক্লাব থেকে তাকে অন্যায়ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল থানা অফিসার ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম জানান, ১০ সাংবাদিকসহ ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় আরও ৫০-৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে তারা আটক করেছেন।
মামলায় যে সাংবাদিকদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন, শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক স্বদেশ প্রতিদিন পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, দৈনিক যুগভেরী পত্রিকার প্রতিনিধি ইমাম হোসেন সোহেল, সাপ্তাহিক শ্রীমঙ্গল বার্তার সম্পাদক মুমিনুল হোসেন সুহেল, সাপ্তাহিক শ্রীমঙ্গল বার্তার বার্তা সম্পাদক মামুন আহমেদ, সাপ্তাহিক চায়ের দেশ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সনেট দেব চৌধুরী, সাপ্তাহিক জয়বার্তা পত্রিকার সম্পাদক ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এডভোকেট আজাদুর রহমান, আরটিভি ও আমাদের সময় এর মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি চৌধুরী ভাস্কর হোম, একুশে টেলিভিশন ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিকুল চক্রবর্তী, দৈনিক খবরের কাগজ পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি হৃদয় দাশ শুভ এবং দৈনিক বাংলার প্রতিনিধি এস কে দাশ সুমন।
মামলায় আসামি শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সভাপতি বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী বলেন, “মামলায় সাংবাদিকদের নামে ঢালাও অভিযোগ করা হয়েছে। এসব অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। সবাইকে বিগত সরকারের দোসর হিসেবে ইদ্রিস আলী মামলায় উল্লেখ করেছেন, যা ভিত্তিহীন। শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ৬-এর ৫ ধারা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করায় ইদ্রিস আলীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তিনি সেটির জবাব দিয়েছিলেন। তার দেওয়া জবাবেও তিনি একটি রাজনৈতিক দলকে (বিএনপি) হল বরাদ্দ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দলকে হল বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম নেই। যে কারনে প্রথমে প্রেসক্লাবের অধিকাংশ কার্যকরি সদস্যদের মতামতে ও সাধারণ সভার মতামতের ভিত্তিতে তাকে বহিষ্কার করা হয়।” তিনি আরও বলেন, “মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সামনে গোলাগুলি, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এটি একেবারেই অসত্য। মামলায় উল্লেখিত ওই দিন (২১ জুন ২০২০) কেন, আজ পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সামনে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ নিয়ে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলেই এর সত্যতা মিলবে।’
মামলার অপর আসামী একুশে টেলিভিশন ও বিডিনিউজ টোয়েন্টেফোর ডটকম এর মৌলভীবাজার প্রতিনিধি বিকুল চক্রবর্তী বলেন, “বিএনপি নেতা ইদ্রিছ আলীর ব্যাক্তিগত আক্রোশে মিথ্যা মামলার কারনে গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এলএলবি (পার্ট ওয়ানের) ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারিনি। তিনি বলেন, আমি সিলেট ল‘ কলেজের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থী। আমার রোল নং- ২৩০১৭৬৭ রেজিস্ট্রেশন নং-২২৬৩০০০২২৯১। শ্রীমঙ্গল থেকে সিলেট গিয়ে অনেক কষ্ট করে ক্লাস করেছি। অপেক্ষায় ছিলাম পরীক্ষার। সাধ্যমতো প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু ইদ্রিছ আলীর মিথ্যা মামলায় পড়ে আমার পরীক্ষা দেয়া হলো না।”
মামলার আসামী দৈনিক খবরের কাগজের শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি হৃদয় দাশ শুভ বলেন, আমি একজন শাররীক প্রতিবন্ধি মানুষ। আমার দুই মাসের একটি সন্তান রয়েছে। এই মুহুর্তে তার কাছে থাকতে পারছিনা। তাকে একটু দুধ কিনে দিতে পারছিনা। আমার ঘরে কোন পুরুষ মানুষ নেই। এই মিথ্যা মামলার কারণে আমি ও আমার পরিবার এখন মানবেতর জীবন যাপন করছি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রতিদিন এর শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন জানান, ওই সময় আমি শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের কার্যকরি কমিটির কোন সদস্য ছিলাম না। আমাকে মিথ্যা অভিযোগে মামলায় জড়ানো হয়েছে।
দৈনিক বাংলার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি এস কে দাশ সুমন বলেন, অসত্য অভিযোগ দিয়ে শ্রীমঙ্গলের সাংবাদিকদের উপর মামলা দেয়ায় আমরা কেউই প্রেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারছিনা। সবাই এলাকাছাড়া। তিনি বলেন, ইদ্রিছ আলী মামলা রেকর্ড করাতে এজহারে উল্লেখ করেছেন তার বিরোদ্ধে ২১ জুন ২০২০ আওয়ালীলীগ যুবলীগ ও ছাত্রলীগ জঙ্গি মিছিল করে প্রেসক্লাবের সামনে এসে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং এলোপাতারী ফাঁকা গুলি বর্ষন করে। এটি একটি অবাস্তব গল্প। শ্রীমঙ্গলে এ জাতীয় ঘটনা ঘটলে বিষয়টি সকল গণমাধ্যমে আসতো। এমনকি বাদী নিজেও একজন সাংবাদিক তার অধিকাংশ সাক্ষিই সাংবাদিক তাদের পত্রিকায়ও কেন তা প্রকাশ হয়নি?
সাপ্তাহিক চায়েরদেশ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সনেট দেব চৌধুরী বলেন, “ওইদিন যে মিছল হয়েছিল সেই মিছল ও প্রেসক্লাবের সামনে ইদ্রিছআলীর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদসভা হয়েছিল সেখানে পুরো ঘটনাই বিভিন্ন ফেইসবুক লাইভে আছে। সেখানে আমরা দেখতে পাই ইদ্রিছ আলী যে সুদের ব্যবসা করে মানুষকে প্রতারণ করেন এবং চাঁদাবাজী করেন তারা তারই প্রতিবাদ করছেন। এই ভিডিওতে ককটেল বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির কোন ঘটনা নেই। তাছাড়া ইদ্রিস আলী বলেছেন ঘটনার সময় পেসেজের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছেন বাস্তবিক অর্থে প্রেসক্লাবে কোন পেসেজে কোন দরেজা নেই।”
এ ঘটনায় শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের নেতৃবৃন্দরা এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও পুলিশী হয়রানী বন্ধের দাবী জানান। শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের কার্যকরি সভাপতি শামীম আক্তার হোসেন জানান, আমরা এই মিথ্যা মামলার নিন্দা জানাচ্ছি। তিনি বলেন, ইদ্রিছ আলী এক প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন আমরা আরেক প্রেসক্লাব। এখানে আমাদের প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের নাম কেন আসামীর তালিকায় আসে।