১৪ দিন বয়সে হাসপাতালে, ৩২ মাস পর বাড়ি
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১০:১১:৪৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৮ বার পড়া হয়েছে
নাফিসা আলিয়া নূহা আর নাফিয়া আলিয়া নাবা। দুই বোন। একই রকমের হলুদ জামা পরেছে। পায়ে গোলাপি জুতা।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ১৪ দিন বয়স থেকে তারা। শুরুতে ওয়ার্ডে ছিলো। এরপর ৬১৮ নম্বর ভিআইপি কেবিনে বেড়ে উঠেছে দুই বোন। এখানেই তারা হাঁটতে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে। এই কেবিনকেই তারা ‘নিজেদের বাড়ি’ মনে করত।
সোমবার (২৫ নভেম্বর) দুই বছর ৭ মাস ২২ দিন বয়সে নূহা-নাবা হাসপাতালের ‘বাড়ি’ ছেড়ে কুড়িগ্রামে নিজেদের বাড়ি ফিরছে। নূহা ও নাবার জন্ম হয় মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো অবস্থায়। শরীরের পেছন ও নিচের দিকে থেকে যুক্ত ছিল তারা। দু’জনের পায়খানার পথও এক ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘কনজয়েন্ট টুইন পিগোপেগাস’। এ ধরনের জোড়া শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা দেশে প্রথম বলছেন চিকিৎসকেরা।
চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রোপচার করা হয়। এপর থেকে নূহা ও নাবা আলাদা হয়। সোমবার হাসপাতালের কেবিন ব্লকের ৬১৮ নম্বর ভিআইপি কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, জিনিসপত্র বস্তায় ভরা হচ্ছে। দুই বোন নূহা ও নাবা হেঁটে বেড়াচ্ছে। একজন বাবার কোলে উঠলে অন্যজনও উঠতে চায়। তবে নূহা তুলনামূলকভাবে শারীরিকভাবে বেশি সুস্থ।
নূহা আর নাবা আনন্দে মেতে থাকলেও হানি নেই বাবা মো. আলমগীর হোসেন এবং মা নাসরিন আক্তারের।একসময় পরিবহনশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন আলমগীর হোসেন। মেয়েদের সাথে হাসপাতালে থাকায় চাকরিটা চলে যায়। এখন বেকার। এইদকে, মেয়দের চিকিৎসার জোগান দিতে জমি বন্ধক রাখতে হয়েছে। জমি বন্ধকের দুই লাখ টাকা আর চার লাখ টাকা ঋণসহ ৬ লাখ টাকার ধাক্কা। বাড়ি ফিরলেই শোধ করতে হবে এই ঋণ। ১১ বছরের ছেলে নাফিউ হোসাইন পড়াশোনায় এক বছর পিছিয়ে গেছে। এখন সে পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। এ পর্যন্ত দুই আটটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও একটি বাকি আছে।
নূহা-নাবার মা নাসরিন আক্তার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মেয়েদের হাত ধরে বাড়ি যাচ্ছি, চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। মেয়েরা জানত হাসপাতালই তাদের বাড়ি। মাঝেমধ্যে রমনা পার্ক আর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গেছি।
নাসরিন আক্তার বলেন, মেয়েদের পেটের মধ্যে পায়খানার রাস্তা করে দেয়া হয়েছে। সেখানে যে ব্যাগটি ব্যবহার করা লাগে তা কুড়িগ্রামে পাওয়া যায় না। এই ব্যাগ কিনতেই মাসে ১২ হাজার টাকা লাগবে। এক সপ্তাহ পরপর ব্যাগগুলো পাল্টাতে হয়। মেয়েদের বাবার চাকরি নেই। অনেক দেনা। মেয়েদের প্রতিদিন মাংসসহ অন্যান্য খাবার খাওয়াতে হবে। কেউ যদি আমাদের মেয়েদের পাশে দাঁড়ান, তাহলে কিছুটা স্বস্তি পাব।
বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি বিভাগের স্পাইনাল নিউরোসার্জারি ডিভিশন প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেনের অধীনে নূহা ও নাবা শুরু থেকেই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তিনি বলেন, এই দুই শিশু হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে, এটাই আমাদের সফলতা।
বিএসএমএমইউর সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান হাওলাদার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, দুই শিশু জোড়া লাগানো অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল। আর আজ একজন মায়ের কোলে আরেকজন বাবার কোলে চড়ে বাড়ি যাচ্ছে। তাদের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৫১ লাখ টাকা। ১৫ লাখ টাকা অনুদান ছাড়া বাকি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করেছে।
নূহা ও নাবার বাবা আলমগীর হোসেন অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিয়ে স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে কুড়িগ্রামের দিকে রওনা দেন। ততক্ষণে নূহা ও নাবার আনন্দে খানিকটা ভাটা পড়েছে। কান্নাকাটি শুরু হয়েছে। তাদের নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার যে যুদ্ধ, তা শুরু হবে বাড়ি ফেরার পর।