সিলেটে যৌথবাহিনীর অ্যাকশন শুরু, লাপাত্তা অস্ত্রধারীরা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৬:৫০:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২৫ বার পড়া হয়েছে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতাকে হঠাতে ভয়ংকর অস্ত্র হাতে নিয়ে সিলেটের শীর্ষ শ্রেণীর নেতাদের সাথে প্রথম সারিতে মিছিলে দেখা মিলেছিলো সেই সব অস্ত্রধারীরা। পুলিশের পাশা পাশি ছাত্রদের উপর গুলিও করতে দেখা গেছে।
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু হওয়া যৌথবাহিনীর অভিযানে ছাত্র জনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি অস্ত্রধারীরা গ্রেফতারের প্রত্যাশা সচেতন সিলেটবাসীর।
জানা গেছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে পিস্তল, শর্টগান, কাটারাইফেল থেকে শুরু করে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসীরা ভয়ংকর স্পাইপার রাইফেলও ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠছে। অস্ত্রধারি সন্ত্রাসীদের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ছররা গুলী, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের তথ্য থাকলেও প্রাণঘাতি বুলেট ব্যবহারের কথা স্বীকার করেনি কেউ। অথচ ছাত্র আন্দোলনে সিলেট নগরীতে গুলীবিদ্ধ হয়েছেন শতাধিক ছাত্র-জনতা। আওয়ামী সন্ত্রাসীদেও ছোড়া প্রাণঘাতি অস্ত্রের গুলীতে বুলেট বিদ্ধ হয়ে এখনো ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন অনেকেই। এছাড়া সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হওয়ার সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
জানা গেছে, বিগত ছাত্র আন্দোলনে সিলেটে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত অনেক অবৈধ অস্ত্রের মধ্যে একটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলছে তোলপাড়। অস্ত্রটিকে কেউ বলছেন একে ফোরটি সেভেন। কেউ আবার এমআর সিক্সটিন, কেউ বা এটিকে বলছেন স্নাইপার। যেটি অতীতে কখনো সিলেটের রাজপথে কোন দিন দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে সিলেটের রাজপথে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে অনেক বার।
এই অস্ত্র বহন করেন শিপলু নামের একজন। পুরো নাম রুহুল আমীন। অনেকটা অপরিচিত এই শিপলু। আন্দোলনের সময় সিলেটের রাজপথে এই অস্ত্রের সঙ্গে শিপলুর নামটি আলোচিত হয়েছে। এরমধ্যে শিপলুকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
কে এই শিপলু- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে; শিপলু যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। ওখানে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সাথে জড়িত। সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর খুব কাছের লোক হিসেবে পরিচিত শিপলুর বাড়ী হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জে। গত ২০ শে জুলাই শিপলু সিলেটে আসেন। এরপর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে রাজপথে নামেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে- সিলেটে এবার প্রথম অস্ত্রের মহড়া শুরু হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে। এরপর থেকে এই অস্ত্রের ঝনঝনানি ছড়িয়ে পড়ে সিলেট নগরীর সর্বত্র। এমনকি পাহারা মহল্লায় ব্যবহৃত হয় আগ্নেয়াস্ত্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটে প্রথমে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন শুরু হওয়ার কারণে শাবি শিক্ষার্থীদের ওপর ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়। পরে আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলের সি ব্লকের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিত শাহ’র ৪২৩ নম্বর রুম থেকে দুটি পিস্তল সাধারণ শিক্ষার্থীরাই খুঁজে বের করে। এরপর ২ আগস্ট থেকে শাবি ফটক ও মদিনা মার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলে সিলেটের যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা প্রকাশ্য অস্ত্র প্রদর্শন শুরু করে। ৩ আগস্ট পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়ায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন পানি ডুবে মারা যায়। সেদিন পুলিশকে পেছনে রেখে ফ্রন্টলাইনে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সুরমা আবাসিক এলাকায় অনবরত গুলি ছুঁড়ে। গুলির শব্দে ওই দিন সুরমা আবাসিক এলাকা প্রকম্পিত হয়। এর আগে ২ আগস্ট ও পরে ৪ঠা আগস্টও এসব এলাকায় গুলিবর্ষণের একাধিক ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মদিনা মার্কেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান, তার সশস্ত্র ক্যাডার আজহার উদ্দিন সুমন, পাঙাস ও তুহিনের নেতৃত্বে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এদিন সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান ওরফে মুরগি হান্নানের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র ক্যাডাররা মাঠে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলি ছুঁড়ে। পুলিশ যখন ছাত্র বিক্ষোভ দমাতে ক্লান্ত তখনই এই সব অস্ত্রবাজরা পুলিশের প্রক্সি হিসেবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ৪ আগস্ট। সে দিন সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টা এলাকায় প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলীবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এমনকি সে দিন উপ পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ, সহকারী কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরের সামনেই প্রকাশ্য দিবালোকে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া হয়।
জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি পীযূষ কান্তি দে তার দলবল দিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। পীযূষের সঙ্গে থাকা তার এক সহযোগীর হাতে ছিল তার সেই বহুল আলোচিত দু’নলা বন্দুক। এ ছাড়া শটগান হাতে যুবলীগ নেতা জাহেদ, মুনিম অখিলি, সজল দাশ অনিক, শান্ত, টিলাগড়ের ভয়ঙ্কর আলোচিত অস্ত্রধারী আনসার, এমসি কলেজের দেলোয়ার হোসেন রাহী, সরকারি কলেজের রুহেল আহমদ, রাজন আহমদ, ছাত্রলীগের তানভীর, সৈকত চন্দ্র রিমী, গৌরাঙ্গ দাশ সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। তারা ওইদিন গুলিবর্ষণ করে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এদিকে শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের দিন ৫ আগস্ট সিলেটসহ সারাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অস্ত্র লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এসব অস্ত্র ফিওে পেতে মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় অন্তর্বরতী সরকার। এছাড়া বেসামরিক লোকজনকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স গত ২৫ আগস্ট স্থগিত করে বর্তমান সরকার। এসব অস্ত্রও জমা দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত তারিখ নির্ধারণ কওে দেয়া হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত এসব সব অস্ত্র ফিরে না পাওয়ায় বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে সারাদেশে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সতর্ক করে সোম ও মঙ্গলবার সিলেটজুড়ে মাইকিং করা হয়।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) সূত্রে জানা গেছে, বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে সারাদেশের ন্যায় সিলেটেও অভিযানে নামছে যৌথবাহিনী। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার ব্যাটালিয়ানের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করবে।
এসএমপির মিডিয়া কর্মকর্তা উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারী থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের দেয়া সকল বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে অন্তর্বরতী সরকার। এছাড়া ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সিলেট নগরীর বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এসময় নগরীর ৬টি থানায় ১০১টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র মিসিং ছিল। এরমধ্যে ৮০ টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ২১ টি এখনো উদ্ধার হয়নি। এছাড়া এসএমপির এলাকায় লাইসেন্স করা ২৪৬টি অস্ত্রের মধ্যে শতাধিক অস্ত্র জমা হয়েছে।