সন্তু লারমাকে টেক্কা দিতেই পাহাড়ের ত্রাস নাথান বাম
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৮:৫৪:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৩৫ বার পড়া হয়েছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা নাথান বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সক্রিয় ছিলেণ ছিল মিছিল-মিটিংয়ে। ১৯৯৬ সালে চারুকলা থেকে পাস নাথান চেয়েছিলেন রাজনীতিবিদ হতে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি । খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কয়ারের পাশে সন্তু লারমার ভাস্কর্যটির অন্যতম কারিগর তিনি।
কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা নাথানের পারিবারিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বহু তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, এক সময় আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে নাথান বমের। বেশিরভাগ সময় থাকতেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। মাঝেমধ্যে চলে যেতেন ভারতের আসাম ও মিয়ানমারে। এভাবে নানা দিকে আনাগোনার একপর্যায়ে গঠন করেন কুকি-চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও)। তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কয়েক বছর পর গড়ে তোলেন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)।
জানা গেছে, লাথান বাম কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’সহ ৬টি বই প্রকাশ করেন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছিলেন। সন্তু লারমাকে টেক্কা দিতেই মূলত নাথান বাম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নাথান বাম দেশের বাইরে থেকে নিয়মিত অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার গ্রুপে বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫ হাজারের মতো। তারা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সেই সাথে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে।
২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ট্রাই-জংশনের কাছাকাছি সীমান্ত লাগোয় ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লংতলাই জেলার পারভা থেকে কেএনএফের ৬ জনকে আটক করে বিএসএফ। এরপর কেএনএফ আলোচনায় আসে।
আটকের পর তাদের কাছে থাকা একটি চিঠিতে কেএনএফের সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সভাপতি ও চিফ অব স্টাফের সিলমোহরসহ কিছু সরঞ্জাম উদ্ধারের কথা জানায় বিএসএফের ১৯৯ নম্বর পারভা ব্যাটালিয়ন। একই বছরের ১২ এপ্রিল পারভা ১১৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ সশস্ত্র সরঞ্জামসহ কেএনএফের ৪ সদস্যকে আটক করে।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি,থানচি, রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা ও আলীকদম উপজেলা নিয়ে কেএনএফের কল্পিত কুকি-চিন রাজ্য গঠিত। বম, পাঙ্খুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো, খিয়াং নামের ৬ জাতিগোষ্ঠীর কিছু লোকজন নিয়ে কেএনএফ গঠিত হয়। তারা নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা মনে করে। একই সাথে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ ও ভারতীয় জাতিভুক্ত এবং বহিরাগত মনে করে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই কেএনএফের সাথে জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার যোগাযোগের নতুন তথ্য সামনে আনে র্যাব। সংগঠনটির কথিত আমির মো. আনিসুর রহমান মাহমুদকে গ্রেপ্তারের পর নাথান বমের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ থাকার বিষয়টি জানা যায়। তাছাড়া নাথান যখন চারুকলার ছাত্র, জামা’আতুল আনসারের নেতা শামিন মাহফুজ তখন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। সেই সময় তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
২০২০ সালের শুরুর দিকে নাথানসহ কেএনএফের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আসলাম নামে এক ব্যক্তির সাথে গহিন পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে যান আনিসুর রহমান মাহমুদ। সেখানে আসলামের তত্ত্বাবাবধানে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় এসে নিজের সম্পত্তি ৫০ লাখ টাকার বেশি দামে বিক্রি করে দেন। এরপর নাইক্ষ্যংছড়িতে তিন বিঘা জায়গা কিনে পরিবারসহ থাকতে শুরু করেন। তিন বিঘা জমির দাম দিয়ে বাকি টাকা তিনি নতুন জঙ্গি সংগঠনকে দেন। ২০২১ সালে নাথানের সঙ্গে জামা’আতুল আনসারের আমিরের একটি সমঝোতা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফের ছত্রছায়ায় জামা’আতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয়। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৩ লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি জামা’আতুল আনসার কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে আসছিল।
বান্দরবানের রুমা সদর ইউনিয়নের ইডেনপাড়ার বাসিন্দা মৃত জাওতন লনচেওর ছেলে নাথান লনচেও বাম। তার বাবা ছিলেন একজন জুমচাষি। তার মায়ের নাম রৌকিল বম। ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে লাথান ছোট।
একসময় জেএসএসের সন্তু গ্রুপের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে (পিসিপি) যোগ দেওয়ার কারণে নাথান বমের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন সন্তু লারমা। এরপর তার জীবন ও পরিবারের জীবনধারা পাল্টে যায়। পরিবারের অনেক সদস্য সরকারি চাকরি পান। নিজের স্ত্রী লাল সমকিম বম রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে যোগ দেন। তাদের দুটি সন্তান আছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সন্তু লারমার সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দেয়। পরে তিনি দল ছেড়ে চলে যান।
কেএনএফের অভিযোগ, বিভিন্ন মহল তাদের ভূমিতে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। জেএসএসসহ অন্য সংগঠনগুলো কুকি-চিন জনগোষ্ঠীদের ভূমি ব্যবহার করে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করে চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুমসহ নিরীহ মানুষদের ভীতির মধ্যে রেখেছে।