বেনজীরের আলাদীনের চেরাগ দুদকে বন্দি
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০২:৩৪:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ মে ২০২৪ ৩৫৩ বার পড়া হয়েছে
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক( আইজিপি) বেনজীর আহমেদের পরিবারের সব স্থাবর- অস্থাবর সম্পদ আদালতের নির্দেশে জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে । এসব সম্পদ চলে গেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের( দুদক) নিয়ন্ত্রণে । এর ফলে ক্ষমতায় থাকাতে আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগের স্পর্শে গড়ে তোলা বেনজীরের বিশাল সাম্রাজ্য কার্যত মুখ থুবড়ে পড়লো । দুদক সূত্রমতে, জব্দ করা সম্পদ তত্ত্বাবধান ও দেখভালের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে ।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও দুদক কর্মকর্তারা বলেন, একজন সরকারি চাকরিজীবী তার চাকরির মাধ্যমে এতো সম্পদ উপার্জন করতে পারেন না । দোষী সাব্যস্ত হলে বিভিন্ন আইনে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড হবে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের । একই সাথে তার সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রাষ্ট্রের বাজেয়াপ্ত করা হবে ।দু’দকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা মিলেছে ।
২৩ মে( বৃহস্পতিবার) ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, পরবর্তী নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা আপিল বিভাগে বহাল থাকবে ।
একজন কর্মকর্তা বলেন, সাবেক আইজিপির জব্দ ও অবরুদ্ধ হওয়া সম্পদের সামগ্রিক তদারকি করবে দুদক । তিন সদস্যের যে তদন্ত কমিটি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছে, তারা একটি কমিটি গঠন করে দেবে । দুদক চাইলে যেসব জেলায় কার্যালয় নেই, সেখানে জেলা প্রশাসনকে দেখভালের দায়িত্ব দিতে পারে । আর অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাবগুলো থাকবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণে ।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, আদালতের আদেশের পর এসব সম্পদ আর বেনজীর আহমেদের দখলে থাকার সুযোগ নেই । এখন এগুলোদু’দকের নিয়ন্ত্রণে । দুদক শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করে রিসিভার নিয়োগ দেবে । তবে কমিশন যে কমিটি গঠন করবে তা আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে ।
রিসিভার কমিটিতেদু’দক কর্মকর্তা, কিংবা জেলা প্রশাসন বা যেকোনো নিরপেক্ষ সংস্থা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে । সব সম্পত্তিতে আদালতের আদেশের সাইনবোর্ড টাঙানো হবে । পাশাপাশি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুলিপি পাঠানো হবে ।
আদালতের আদেশের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জা, তিন মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে থাকা ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে । এসব দলিলে মোট সম্পদের পরিমাণ৩৪৬.৩০ বিঘা । যার দলিলমূল্য ১০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা । তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব জমির দাম কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ গুণ বেশি বলে জানা গেছে ।
এ ছাড়া তাদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে সাধারণ হিসাব, সঞ্চয়পত্র, ক্রেডিট কার্ডসহ ৩৩টি হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত । এসব ব্যাংক হিসাবে কী পরিমাণ অর্থ সংরক্ষিত আছে তা জানা যায়নি । আদেশে বলা হয়, এসব ব্যাংক হিসাব থেকে কোনোভাবেই টাকা উত্তোলন করা যাবে না ।দু’দকের বিধিমতে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের অধীনে বেনজীরের হিসাবগুলো অবরুদ্ধ থাকবে ।
জানা গেছে, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা নামে- বেনামে যেসব অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, তা বিক্রি ও হস্তান্তরের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের চেষ্টা করছেন বলে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনদু’দকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর । অনুসন্ধান বা মামলা নিষ্পত্তির আগে বর্ণিত সম্পত্তি হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন ।
শুনানিতে তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ নামে, স্ত্রী ও মেয়েদের নামে দেশে- বিদেশে শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়েছে । সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিপুল পরিমাণ স্থাবর- অস্থাবর সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করেছেন ।
পরে এই বিষয়ে আদেশ দেন আদালত । আদেশে বিচারক বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তার আবেদন ও অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় আর্জি মঞ্জুরযোগ্য মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে । বর্ণিত স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক( জব্দ) ও অস্থাবর সম্পত্তি ফ্রিজ( অবরুদ্ধ) করা না হলে তা হস্তান্তর হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে । ফলে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না ।
এদিকে শুকবার( ২৪ মে) সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদের সম্পদ জব্দের আদেশ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, অপরাধ করলে কেউ পার পাবে না । বিচার বিভাগ স্বাধীন,দু’দকও স্বাধীন । সেখানে যদি কেউ অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হন, আমরা তাকে প্রটেকশন দিতে যাব কেন? তিনি সাবেক আইজিপি হোন আর সাবেক সেনাপ্রধান হোন ।
এর অঅগে চলতি বছরের ৩১ মার্চ একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় ‘ সাবেক আইজিপির অপকর্ম- ১ ’ । এই পর্বে ‘ বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ ’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোপালগঞ্জে বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ৬০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত চোখধাঁধানো রিসোর্ট । তার পাশে কিনেছেন আরও ৮০০ বিঘা জমি । শুধু তাই নয়, রাজধানী ঢাকার গুলশানে ১৭ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটসহ দেশে- বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন তিনি ।
হিসাব করে দেখা গেছে, ৩৪ বছর ৭ মাসের চাকরিজীবনে সাবেক আইজিপি বেনজির বেতন- ভাতা বাবদ আয় করেছেন এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা । এর ফলে তার এই বিপুল সম্পদের বৈধ উৎস নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন ।
এ ছাড়া গত ২ এপ্রিল একই জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় ‘ সাবেক আইজিপির অপকর্ম- ২ ’ । এই পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘ বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট ’ । অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুরের ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর রিসোর্ট গড়ে তোলা হয় । এতে বনের জমিই রয়েছে অন্তত ২০ বিঘা । ওই রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীরের পরিবারের হাতে ।
এসব প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর দেশে- বিদেশে আলোচনার ঝড় তোলে । পরে গত ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান । ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি । একই দিন বেনজীরের অনিয়ম- দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকে আবেদন করেন সংসদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ।
এরপর ২২ এপ্রিল ৩ সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দুদক । কমিটির সদস্যরা হলো- কমিশনের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও নিয়ামুল হাসান গাজী । ২৩ এপ্রিল হাইকোর্টের এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন হলফনামা আকারে জমা দিতে বলা হয় ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনুসন্ধান কমিটির এক সদস্য বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তারা অনুসন্ধান শুরু করেন । প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেনজীর ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে । অনুসন্ধান এখনও চলমান রয়েছে । পরবর্তী সময়ে আরও তথ্য পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে ।
অন্যদিকে, গাজীপুরে ভাওয়াল রিসোর্ট নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে পরিবেশ অধিদপ্তরও । প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে ঘটনার সত্যতা পায় পরিবেশ অধিদপ্তর । পরে ১৪ মে তলব করা হয় রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে । এদিন পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া রিসোর্ট পরিচালনা এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধন করায় ভাওয়াল রিসোর্টকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার( ২৪ মে) পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক( মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বলেন, ভাওয়াল রিসোর্টে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করা হয় । একই সাথে তাদের কার্যক্রম বন্ধেরও নির্দেশ দেয়া হয় ।
অভিযোগ প্রমাণ হলে যে সাজা হতে পারে চাকরি করে এতো সম্পদ উপার্জন করা অসম্ভব বলে উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক । তিনি বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৬ ও ২৭ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭- এর ৫- এর ২ ধারা, অর্থপাচার আইন ২০১২- এর ৪ ধারাসহ বিভিন্ন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় তার( বেনজীর আহমেদ) বিচার হবে । অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভিন্ন আইন ও ধারায় দীর্ঘ মেয়াদে তার সাজা হতে পারে । একই সাথে রাষ্ট্রের অনুকূলে তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে ।
তিনি আরও বলেন, বাজেয়াপ্ত সম্পদ দেখভাল করা দুদকের পক্ষে অত্যন্ত জটিল কাজ । এর আগেও বহু মামলায় অনেকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে । এগুলো দেখভালের জন্য দুদকের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি ।
অর্থপাচার আইন ২০১২- এর ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি মানি লন্ডারিং অপরাধ করিলে বা মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করিলে তিনি অন্যূন চার বৎসর এবং অনধিক ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে ।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪- এর ২৭( ১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার নিজ নামে, বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তির নামে, এমন কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির দখলে রয়েছে বা মালিকানা অর্জন করেছে, যা অসাধু উপায়ে অর্জিত হয়েছে এবং তার জ্ঞাত আয়ের উৎসর সহিত অসংগতিপূর্ণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে এবং তিনি উক্তরূপ সম্পত্তি দখল সম্পর্কে আদালতের নিকট বিচারে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান করিতে ব্যর্থ হলে উক্ত ব্যক্তি অনূর্ধ্ব ১০ বছর এবং অন্যূন তিন বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে এবং উক্তরূপ সম্পত্তিসমূহ বাজেয়াপ্ত যোগ্য হবে ।
দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭- এর ৫( ২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি অসদাচরণ করলে অথবা করিতে সচেষ্ট হলে তিনি অনধিক ৭ বৎসর কারাদণ্ড, অথবা অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন, এবং ফৌজদারি অসদাচরণের সহিত সম্পর্কিত আর্থিক সহায় বা সম্পদও রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা যাইবে ।