পাহাড়ের আতঙ্ক কেএনএফ
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৫:৪৪:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৫৫ বার পড়া হয়েছে
পাহাড়ে সক্রিয় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে নতুন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। তবে তারা এখন খুনোখুনি, অপহরণ,ব্যাংক লুট,চাঁদাবাজি ও জঙ্গিদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে বারবার আলোচনায় আসছে। বান্দরবানে বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু ব্যক্তি এই সংগঠন গড়ে তোলেন।
এর ফলে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানছি স্থানীয়দের মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, অবনতি হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্য,পিছিয়ে যাচ্ছে পর্যটন শিল্পসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং ব্যাহত হচ্ছে সরকারি উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড। তবে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ এর সদস্যদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বান্দরবানে গঠন করা হয়েছিল পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ক্যশৈহ্লার নেতৃত্বে শান্তি কমিটি। শান্তি কমিটি দুই দফা সরাসরি বৈঠকও করেছে। তবে বৈঠকে সাতটি দাবীও দেওয়া হয়েছে কেএনএফ এর পক্ষে থেকে।
তবে রুমা ও থানচিতে দুটি ব্যাংক থেকে টাকা লুট ও ব্যাংক কর্মকর্তাকে অপহরণের ঘটনায় সশস্ত্রগোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা বন্ধ ঘোষণা করেছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি পক্ষে থেকে। সম্প্রতি সময় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যরা সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন। কেএনএফ কর্তৃক ব্যাংক লুট ও অস্ত্র ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা হতে পারে বলে সম্মেলনে জানানো হয়।
পাহাড়ে চলমান সংঘাত বন্ধের আহবান জানিয়ে স্থানীয়রা জানান, আমরা সংঘাত চাই না।আমরা চাই শান্তিতে নিজেদের বসবাড়ীতে বসবাস।মিলেমিশে ব্যবসা বাণিজ্য করতে।এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আসুক।স্থানীয় জন প্রতি নিধিরা জানান,সংঘাত,চাঁদাবাজী এর কারণে এলাকার মানুষ আতংকে রয়েছে।
এদিকে, নিজেদের অধিকার আদায়ের নামে বম সম্প্রদায়ের যুবকদের নিয়ে ২০২২ সালে বান্দরবানে আত্মপ্রকাশ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট(কেএনএফ)।সেই সময় জেলা রুমার দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল কেএনএফ। সেনাবাহিনী ও র্যাব সদস্যদের অভিযানের মুখে ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ধ্বংস হয়। কেএনএফ ও জঙ্গি সংগঠনের একাধিক সদস্য ধরা পড়ে। এর আগেও সংগঠনটির হামলায় দুজন সেনা সদস্য নিহত হন। তারা রুমা এলাকা থেকে পর্যটকদের অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক কাজে প্রকাশ্যে জড়িয়ে পডেছিল। তবে কেএনএফ দুর্গম রুমাকেই তাদের কর্মকান্ডে।
এই সংগঠনটির প্রধান হলেন নাথান লনচেও বম,যিনি সংক্ষেপে নাথান বম বলে পরিচিত।বয়স আনুমানিক ৪৪ বছর।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন।
অপরদিকে, ১৯৯৭ সালে পাহাড়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শান্ত করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক সংগঠন জন সংহতি সমিতি এর সাথে শান্তি চুক্তি করে আওয়ামীলীগ সরকার। এরপর দীর্ঘদিন পাহাড়ে শান্তি বজায় থাকলেও গোষ্ঠী ভিত্তিক দ্বন্ধের জেরে পার্বত্যাঞ্চলে একের পর এক উত্থান হয়েছে নতুন নতুন আঞ্চলিক দলের। গেল এক দশকে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে আত্ম প্রকাশ ঘটেছে জেএসএস সংস্কার,ইউপিডিএফ,ইউপিডিএফ সংস্কার,মগ লিবারেশন পার্টি ও কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠনের। আর এসব সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জেরে জড়িয়ে পড়ছে গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে, শুধু তাই নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও পিছপা হচ্ছে না তারা।
পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন কেএনএফ এর হামলায় প্রাণ হারায় সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট মাস্টার অফিসার নাজিম উদ্দিন। আহত হয় আরো দুই সেনা সদস্য। এরপর থেকে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার পরিবেশ। এমন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিন উপজেলায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রশাসন। আর এসব কারণে ভয়,উৎকণ্ঠা ও শঙ্কায় দিন যাপন করছে পাহাড়ে বসবাসকারী বাসিন্দারা। তবে পাহাড়ের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য গোষ্ঠী ভিত্তিক দ্বন্ধ, অরক্ষিত সীমান্ত,অপ্রতুল সেনা ক্যাম্প ও অস্ত্রের অবাধ সরবরাহকে দায়ী করে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর।
তিনি বলেন,পাহাড়ে এখন আমরা কেউ নিরাপদে নেই। কখন কোন সময় কার উপর হামলা হয় আমরা সব সময় সেই ভয়ে আছি।পাহাড়ের ভিতরে ব্যবসায়ীরা যেতে পারছেনা। বাঙ্গালী নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রী কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মজিবুর রহমান বলেন,কেএনএফ এ পার্বত্য এলাকায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। সরকারের ব্যাংক লুট ও পুলিশের অস্ত্র লুট করা মানি সরকারকে হুমকি দেওয়া। তবে তোষামোদি করে শান্তি কমিটির নামে যেই আলোনা চলছে এইটা আসলে ব্যথ হয়েছে।তবে সরকার যদি সিন্ধান্ত নেয় তাহলে একদিনের মধ্যে কেএনএফ নির্মূল করা কোন ব্যাপার না।
পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহবায়ক ক্যশৈহ্লা বলেন,পাহাড়ে কেএনএফ এর সদস্যদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে শান্তি কমিটি দুই দফা বৈঠক করার পরও তার যেই ভাবে সস্ত্রাসী কর্মকন্ড চালিয়েছে তাদের সাথে সংলাপের পথ বন্ধ হয়েগেছে। তবে তাদের বিপদ গামী থেকে ফিরিয়ে আসতে হবে তা না হলে তাদেরকে দমন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি করেছে। এখন অনেক উপদল আছে। এসব উপদল কিংবা দ্বিমত থাকতেই পারে। তবে একই ধরনের চুক্তি সবার সঙ্গে করতে হবে, এমন আশা করার সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) শতাধিক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রাত সাড়ে ৯টার দিকে এসে রুমা ইউএনও অফিসসংলগ্ন মসজিদ ও ব্যাংক ঘেরাও করে। পরে তারা সোনালী ব্যাংকের টাকাসহ ডিউটিরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়।তারা যাওয়ার সময় রুমা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে।
পরদিন বুধবার (৩ এপ্রিল) থানচি উপজেলা শহরের সোনালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় হামলায় চালিয়ে নগদ অর্থ নিয়ে যায়।রুমার ঘটনার পরপর যৌথ অভিযান চালিয়ে (৪এপ্রিল) রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংক শাখার অপহৃত ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে র্যাব ও সেনাবাহিনী।
অরপদিকে, রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংকে হামলা,টাকা ও অস্ত্র লুটসহ ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট সাতটি মামলা হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও র্যাব এ ঘটনায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সম্পৃক্ততার কথা বললেও মামলায় সংগঠনটির কোনো নেতা বা সশস্ত্র হামলাকারী কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ১৮০ জনকে।
জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন,রুমা ও থানচির ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট সাতটি মামলা হয়েছে। জড়িত আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে।