নাম জটিলতায় ধানের জাত বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৫:০৪:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ মে ২০২৪ ৪৬৯ বার পড়া হয়েছে
১৯৯৩ সালের পূর্বে বিআর-১ থেকে বিআর ২৬ পর্যন্ত প্রতিটি ধানের নাম মনে রখার জন্য একটি করে ডাক নাম দেওয়া হয়েছিল । ধান বা চালের আকার ও আকৃতির সাথে মিল রেখে ধানের ডাক নামের প্রচলন করা হয়। ধান থেকে উৎপাদিত চালের নাম ধানের ডাক নাম হিসাবেই ক্রেতা ও বিক্রেতার কাছে পরিচিতি লাভ করে । যেমন বি আর ১১ ধানের চাল মুক্তা , বিআর ১৬ ধানের চাল শাহীবালাম, বি আর ২৫ ধানের চাল পাইজাম নামে বাজারে পরিচিতি লাভ করে ।
কিন্তু ১৯৯৩ পরবর্তী ধানের নাম বিআর থেকে ব্রি তে পরিবর্তন করা হয়। ব্রি সাথে শুধু জাতের অবমুক্তির ক্রমিক নং যুক্ত করে বর্তমানে প্রায় ৮১ টি ধানের নামকরণ করা হয়। এই জাতগুলোর কোনো ডাক নাম না দেওয়ায় বাজারে ধানের নাম অনুযায়ী চালের নামকরণ করা জটিল হয়ে পড়ে। বিষয়টি সমাধানের জন্য ব্যবসায়ীরা চালের নাম নিজেদের মত করে নামকরণ করে। এক্ষেত্রে দানার আকার ও আকৃতি পূর্বের অবমুক্ত জাতের সাথে মিল রেখে সেই নামেই বিক্রয় করতে থাকে। ব্রিধানের ক্ষেত্রে ব্রিধান ২৮ ও ২৯ চাল ২৮ ও ২৯ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
চালের নামকরণের ব্যাপারে কোনো সরকারি দিকনির্দেশনা না থাকায় সরু ও মাঝারি লম্বা ধানের মত চাল গুলোকে মিনিকেট যেমন ব্রিধান ২৮ কে ২৮ মিনিকেট, জিশাইলকে মিনিকেট ব্রি ধান ৪৯ কে নাইজারশাইল, ব্রিধান ২৯ কে পাজাম ২৯ চাল ; ব্রিধান ৫০ কে বাসমতী নামে, ব্রি ধান ৩৪ কে চিনিগুড়া নামে ক্রেতা ও বিক্রেতার কাছে পরিচিতি লাভ করে। এছাড়াও দেশে প্রায় ৩০৪ টি ধান প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে অবমুক্ত হয়েছে। এর সাথে স্থানীয় জাতের কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, তবে এর সংখ্যা শতাধিক।
যেমন — কালিজিরা, কাটারি, জিরশাইল, বেগুন বিচি , উকনি মধু এখন সদর্পে টিকে আছে । এতগুলো জাত আলাদা আলাদা লটে দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা যেমন -দুরহ পাশাপাশি মিলিং পরবর্তী চাহিদা অনুযায়ী ব্যাবসায়ীকদের নিকট সরবারাহ করাও বেশ জটিল কাজ। কাজটা সহজ করার জন্য মিলারগণ ধানের দানার আকার আকৃতির সাথে মিল রেখে, কয়েকটি জাতের ধান একত্রে মিশিয়ে চাউল উৎপাদন করে থাকে, যেমন ব্রিধান ২৮, ৮১, ৮৭, জিরাশাইল, বিনা ধান ৭ এর চাউলের দৈর্ঘ্য প্রস্থ অনুপাত প্রায় কাছাকাছি, ফলে চালের আকৃতি প্রায় একই রকম।
আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী ধান যাই হোক উৎপাদিত চাল দানার দুটি বৈশিষ্ট্যর উপর ভিত্তি করে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১ম বৈশিষ্ট হল ধান বা চালের আকার বা দৈর্ঘ্য। দৈর্ঘ্য অনুযায়ী চাল দুই রকম যথা লম্বা ও খাটো। লম্বা চাল আবার তিন রকম অতি লম্বা > ৭মি.মি., লম্বা ৬.৬- ৭.৫ মি.মি, মাঝারি লম্বা ৫.৫-৬.৫ মি.মি । খাটো চাউল হলো< ৫.৫ মি.মি। ২য় বৈশিষ্ট্য হলো চালের আকৃতি অনু্যায়ী বা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত। এ অনু্যায়ী চাল ২ রকম যথা চিকন ও মোটা। চিকন চাল আবার দুই রকম যথা চিকন >৩ ও মধ্যম চিকন ২.১-৩। মোটা চাল ও দুইরকম যথা মোটা ১.১-২ ও অতি মোটা বা গোলাকার <১.১।
বর্তমান খাদ্য অধিদপ্তর ধানের নামে চালের নামকরণের মাধ্যমে মিলারগণকে বাজারজাত করতে বলছেন। এতে বড় সমস্যা হলো ভোক্তা পর্যায়ে ধানের নাম তেমন পরিচিত নয়, পাশাপাশি উৎপাদিত চালের গুনগত মান এর ব্যাপারেও যথাযথভাবে অবগত নয় ।
যেমন পূর্বে জিরাশাইল ধান থেকে উৎপাদিত চাউল কে মিনিকেট নামে বাজারজাত করা হতো কিন্তু বর্তমানে এই চালকে জিরাশাইল চাউল নামে মিলারদেরকে বাজারজাত করতে হচ্ছে। জিরাশাইল আর আগের মিনিকেট চাউল যে একই তা দোকানদার ও ভোক্তা পর্যায়ে বোঝাতে মিলারদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ সাধারণভাবে মানুষ মনে করে, যে কোনো ধান মেশিনে ছেটে মিনিকেট চাউল তৈরি করা হয়। ফলে মিলারদেরকে ব্যবসায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। আবার বিআর ২৬, বিনা ধান ৭ ও ধানি গোল্ডসহ বেশির ভাগ হাইব্রিড ধানের চাউলের ভাতের স্থায়িত্বকাল কম ও ভাত নরম ও আঠালো হওয়ায় এই চাল কেউ কিনতে চায়না । তাই মিলারগণ সরাসরি এই ধানের নামে চাউল বিক্রয় করতে পারবেনা। কিন্তু স্থানিক উপযোগিতার বিবেচনায় জাত গুলো কৃষকের কাছে লাভজনক। জতীয় খাদ্য উৎপাদন সর্বোচ্চ করতে ভূমিকা রাখছে।
বর্তমান মাঠ পর্যায়ে আমন, আউশ ও বোরো সহ তিন মৌসুমে প্রায় ৩০- ৪০ জাতের ধান আবাদ হলেও বাজারে সব মিলিয়ে ১০ – ১৫ টি নামে চাল বিক্রয় হয়। যদি শুধু ধানের নামে চাউলের নাম করা হয় মাঠে আবাদি জাতের সংখ্যা কমে যাবে। এমনিতেই ধানের শতাধিক স্থানীয় জাত বিলুপ্তির পথে। উদ্ভাবিত আধুনিক জাত গুলোও আস্তে আস্তে বিলপ্তির পথে যাবে। ধানের জাতগুলোকে মাঠে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বোপরি বিষয়টি নিয়ে আরও আলাপ আলোচনা করা দরকার। এক্ষেত্রে দানার আকৃতির উপর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী চালের নামকরণ ( লম্বা, খাটো, চিকন ও মোটা) করা অধিক যুক্তিযুক্ত।
ধানের জাতের নামের পাশাপাশি বস্তার গায়ে প্রচলিত বা পরিচিত নামও যুক্ত করা যেতে পারে।
লেখক : কৃষিবিদ মো. নওশাদ হোসেন
ব্যবস্থাপক
ধান ও ধান বীজ উৎপাদন প্রকল্প
প্রাণ এগ্রো লি.