গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী : রফিকসহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১১:৪০:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জুন ২০২৪ ৭১ বার পড়া হয়েছে
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নাওড়ায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী দ্বীন ইসলামের মা ঝর্ণা বেগমের আহাজারি যেন কিছুতেই থামছে না । ছেলে হারানোর শোকে তিনি মূর্ছা যাচ্ছেন।
এদিকে, স্কুল শিক্ষার্থী দ্বীন ইসলাম নিহতের ঘটনায় জসু মেম্বারকে প্রধান আসামি করে রফিকুল ইসলাম, শফিক, আলাল, মিজানুর রহমান, সেলিম, নাপিত দুলালসহ ৩১ জনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। শুক্রবার (৭ জুন) রাতে নিহতের বাবা বিল্লাত হোসেন বাদী হয়ে এই অভিযোগ দায়ের করেন।
আরও পড়ুন :সাবেক আইজিপি বেনজীরের ৩ কালো হাত
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (৬ জুন) বিকেলে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক, তার ভাই মিজানুর রহমান ও শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে অস্ত্রধারী একদল সন্ত্রাসী নাওড়া এলাকার সাবেক মেম্বার মোশারফ ভূঁইয়ার বাড়ি জবরদখল করতে যায়। এই সময় দ্বীন ইসলাম ও মোশারফ মেম্বারের লোকজন তাদের বাধা দেয়। এক পর্যায়ে রফিকের নির্দেশে জসু মেম্বার শটগান দিয়ে গুলি ছোড়ে। এই গুলি দ্বীন ইসলামের পেটে ও বুকে লাগে। সাথে সাথে দ্বীন ইসলাম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে জসু মেম্বারের কাছ থেকে মিজান শটগান ছিনিয়ে নিয়ে দ্বীন ইসলামের বুকে গুলি করে। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
দ্বীন ইসলামের স্বপ্ন উড়ে গেল মিজানের গুলিতে:
‘আমার চানডার কি দোষ আছিল গো! আমার পুতে (ছেলে) কইত, মা আমি বড় অইয়া মানুষ অইমু। তোমগো দুঃখ শেষ করমু। বাবার আর কষ্ট কইরা মাছ বেচবার লাগব না। আমার পুতের আশা খান খান কইরা দিল মিজানে। রফিকের নির্দেশে মিজান নিজে গুলি কইরা আমরার পোলাডারে মাইরা ফালাইছে।’
বুক চাপড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন আর কথাগুলো বলছিলেন নাওড়ায় নিহত এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থী দ্বীন ইসলামের মা ঝর্ণা বেগম।
কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নাওড়া মধ্যপাড়া হাজিবাড়ি মসজিদের পেছনের বাড়িটি বিল্লাত হোসেনের। শুক্রবার (৭ জুন) বিকেলে সরেজমিনে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িটির ভেতরে নারী-পুরুষের জটলা।
নিহত দ্বীন ইসলামের মা ঝর্ণা বেগম, বোন শিলা আক্তারের বুকফাটা আর্তনাদে আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। তাদের পাশে থাকা নারীরাও অভিশাপ দিচ্ছিলো। খানিক পর ঘরে প্রবেশ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন দ্বীন ইসলামের বাবা বিল্লাত হোসেন। পরে কয়েকজন তার মুখে পানির ঝাপটা দিলে জ্ঞান ফিরে আসে তার।
এরপর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। বিল্লাত হোসেন বলেন, ‘আমার পোলায় তো কোন দোষ করে নাই। আমার পোলারে ক্যান মিজানে গুলি করলো? পোলাডায় কইত, বাবা আমাগো অভাবের দিন শেষ অইব। আমি লেহাপড়া কইরা বড় অমু। আর লেহাপড়া করতে না পারলে বিদেশ যামুগা। পোলাডায় লেহাপড়ার ফাহে (ফাঁকে) ফাহে কাম করত। আমি কইতাম, বাবা তোর কাম করার দরকার নাইগা। লেহাপড়া কর। আমার কতা হুনত না। কইত, তুমি একলা কষ্ট করবা ক্যান, বাবা! আমার হেই সোনার টুকরারে আমি এহন কই পামু?’
আরও পড়ুন :বেনজীরের সাভানা পার্ক জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে
পাশ থেকে মা ঝর্ণা বেগম বলেন, ‘পুতের স্বপ্ন আছিলো লেহাপড়া শিখা (শিখে) পুলিশ অইব। পুতে মেট্রিক পাস করছে। অভাবের লেইগ্যা কইছিলাম ঈদের পর মালয়েশিয়া পাডাইয়া দিমু। কাগজপত্রও করছি। কোনোডাই ওর কপালে জুটল না। মাইয়া দেখছিলাম বিয়া করামু। আমার একটা মাত্র পোলা। চাইছিলাম, বিয়া করাইয়া নায়-নাতকুরের মুখ দেখমু। কিছুই অইল না। আমার বংশে বাত্তি (আলো) দেওয়ার আর কেউ রইল না। আল্লাহ তুমি রফিফ, মিজানের বিচার কইরো।’
দ্বীন ইসলামের বোন শিলা আক্তার বলেন, আমার ভাইডা শান্তশিষ্ট আছিলো। কেউর লগে কাইজা-ঝগড়া করত না। বাবার পাশাপাশি ও কাম করতো। আমি আমার জামাইর বাড়ি থেইক্যা বাপের বাড়িত আইলে কইত, মা পিঠা বানাও, আমার বোইনে খাইব। অহন আর কেডা কইব এই কতা। আমার ভাইরে তো ওরা মাইরা ফালাইছে।’
ওই বাড়িতে আসা কয়েকজন নারী-পুরুষ বলেন, ‘দ্বীন ইসলাম পোলা হিসেবে ভালা আছিলো। লেহাপড়া করত। কাম করত। কারো লগে কোনো সময় কাইজা-ঝগড়া করে নাই। এ রহম একটা পোলারে মাইরা ফালাইছে, এইডার বিচার আল্লায় করব।’
এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, আমরা সাধারণভাবে জীবন যাপন করতে চাই। নাওড়া একটা সুন্দর গ্রাম হয়ে উঠুক, এটা চাই। আমরা রফিক-মিজান হায়েনার কাছ থেকে মুক্তি চাই। ওরা বাঘের চেয়ে হিংস্র। ওরা মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলে। নাওড়ায় এ পর্যন্ত কয়েকটা খুন করেছে ওরা। দ্বীন ইসলামের আগে স্বাধীন নামে এক ছেলেকে খুন করেছে রফিক-মিজান গং।’
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, রফিক-মিজান বলে বেড়াচ্ছে, একটা খুন ওগো লেইগা বিষয় না। ওগো নাকি টাকা-পয়সার অভাব নাই। তিন কোটি টাকা রাখছে খুন থেকে বাঁচার লাইগা। আর পুলিশ নাকি হেগো পকেটে। আরও বড় বড় মন্ত্রী-এমপি নাকি হেগো লগে আছে। আল্লায় জানে আবার কারে খুন করে।
স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাগো ভরসা আল্লাই। হের পরে শেখ হাসিনা। তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ দেখেন। তিনি বিচার করব। এই হায়েনাগো বিচার আল্লায় করব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাগো বাঁচান।’
এদিকে রূপগঞ্জের নাওড়া এলাকায় এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকার মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন। শুক্রবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা করা হয়নি।
এ বিষয়ে রূপগঞ্জ থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এলাকার বিভিন্ন স্পটে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় এখনো কেউ মামলা করেনি। আমরা অভিযোগও পাইনি।