গরু ‘মাফিয়া’ ইমরান, সঙ্গী ছিলো বেনজীরও
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৯:০১:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪ ১১৬ বার পড়া হয়েছে
ছাগলকান্ডের পর আলোচনায় আসে সাদিক অ্যাগ্রোর কর্ণধার আলোচিত শাহ ইমরান হোসাইন। কোরবানির ঈদে উঁচু দরে পশু বিক্রি করতে প্রচার-প্রচারণাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য।
একটি বিদেশি চোরাই গরুর দাম কোটি টাকা হাঁকিয়ে আলোচনায় আসেন গরু ‘মাফিয়া’ ইমরান। এরপর ব্যাপক আলোচনায় আসেন কোরবানির ঈদে উচ্চমূল্যের আরেকটি ‘চোরাই’ ছাগলকাণ্ডে।
এর আগে অনেকবার পার পেয়ে গেলেও এবার আর রেহাই মিলছে না গরু ‘মাফিয়া’ ইমরানের। এরইমধ্যে তার জাল-জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুদক। বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে থলের বিড়াল। সাদা চোখে ইমরানকে খামারি মনে হলেও, তলে তলে তিনি আন্ত:দেশীয় গরু পাচার চক্রের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এই সিন্ডিকেটই দেশের ৭৫ হাজার কোটি টাকার পশু ব্যবসার বিরাট অংশের নিয়ন্ত্রক।
ইমরানের সিন্ডিকেটের সঙ্গী হিসেবে রয়েছে রাজনীতিবিদ, আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা । দুর্নীতির মাধ্যমে তাদের বানানো অঢেল কালো টাকার উৎস ছিলো সাদিক অ্যাগ্রো। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইমরান গড়ে তুলেছেন খামার। অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সেসব খামারেই ঢুকতো গাদা গাদা কালো টাকা। এরপর সাদা হয়ে তা বেরিয়ে যেতো।
দুর্নীতি ও অবৈধভাবে অঢেল সম্পদ বানানোয় অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদও সাদিক অ্যাগ্রোতে বিনিয়োগ করেছেন। জানা গেছে, তাতে আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে। তবে এখানেই শেষ নয় ইমরানের আমলনামা। তার বিরুদ্ধে রয়েছে সরকারি সম্পত্তি দখলেরও অভিযোগ। ইমরানের এসব চিত্র এখন সবার সামনে। জাল-জালিয়াতি করে রাষ্ট্রের হেফাজতে থাকা সম্পদ নিজের করে নিয়েছেন এই গরু ‘মাফিয়া’।
এরমধ্যে ইমরানের এই বিশাল খামার সাম্রাজ্যের কবর খোঁড়ার সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। আমদানি নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু ইমরানের খামারে কীভাবে এলো, চোরাই পথে কীভাবে দেশে আনা হয়েছিলো, এসব সন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে সরকারি প্রতিষ্ঠান সাভারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার এবং বিমানবন্দরের কাস্টমস হাউজে চালানো হয় অভিযান।
যদিও ছাগলকাণ্ডের পর গা ঢাকা দিয়েছিলেন ইমরান। সেই নীরবতা ভেঙে স্যোশাল মিডিয়ায় সরব উপস্থিতি।
কীভাবে উত্থান ইমরানের : ছোট্ট একটি খামার দিয়ে যাত্রা শুরু করেন ইমরান হোসাইন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ১৬ বছর আগে পশু পালনের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তার দাদার বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ এবং নানা বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলায়। ১০ ভাইবোনের মধ্যে ৯ নম্বর ইমরান।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৫ বন্ধু মিলে কোরবানির ঈদে পশুর ব্যবসা শুরু করেন ইমরান। একপর্যায়ে সাদিক অ্যাগ্রো নামে খামার শুরু করেন। এরপর তরতর করে বেড়ে উঠেন ইমরান। সারাদেশের গরুর খামারিদের নিয়ে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন। তিনি সেই সংগঠনের সভাপতি।
গরু পাচারের প্রতিবাদের জেরে ২০১৯ সাল থেকে সংগঠনের সদস্যদের সাথে ইমরানের দূরত্ব তৈরি হয়। সমিতির ১৬ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। ইমরানের দৌরাত্মে ডেইরি ফারমার্স সমিতি এখন কার্যত অচল।
সূত্রমতে, দেশের সীমান্ত থেকে রাজধানী পর্যন্ত বিস্তার করেছেন গরু চোরাচালানের সিন্ডিকেট। বিভিন্ন দেশ থেকে চোরাইপথে আনা হয় গরু। এজন্য স্তরে স্তরে রাখা হয় দালাল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তোলা হয় গরু রাখার গোপন ডেরা। দেশে গরু চোরাচালানের মাস্টারমাইন্ড ইমরান হোসাইন।
ঢাকার সাদিক অ্যাগ্রো খামারের আড়ালেই ইমরান গরু চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ করে। মাত্র কয়েকটি গরু নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইমরানের ব্যবসা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ফুলেফেঁপে ওঠে। কারণ, প্রভাবশালীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে ইমরান চোরাচালানের জড়িত হন বলে একপি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সরকারি সম্পত্তি দখল করে পশু বিক্রির বিশাল হাট গড়ে তোলেন ইমরান। যদিও এই হাটের কোনো অনুমোদন ছিলো না। এমনকি নেই কোন ইজারাদার। এরপরও প্রভাব বিস্তার করে বছরের পর বছর ব্যবসা করেন আলোচিত খামারি ইমরান।
যে ছাগল নিয়ে এতো কাণ্ড। সেই ছাগল নিয়ে ঈদের কিছুদিন আগে থেকেই জোরেশোরে মার্কেটিংয়ে নামেন গরু ‘মাফিয়া’ ইমরান। তিনি প্রচারণা চালান যে, এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ছাগল। পাঞ্জাবের বিটল জাতের ছাগলটি তিনি দুই মাস আগে যশোর থেকে কিনেছেন সাড়ে ১০ লাখ টাকায়। এখন তিনি বিক্রি করবেন ১৫ লাখ টাকায়।
একই ঘটনা ঘটেছিলো ব্রাহমা জাতের গরু নিয়ে। গত এপ্রিলে ঢাকায় প্রাণিসম্পদ মেলায় প্রদর্শন করা হয় ১ হাজার ৪০০ কেজি ওজনের একটি ষাঁড়। আরে দাম হাঁকা হয়েছিলেঅ ১ কোটি টাকা। কারণ হিসেবে গরুটির বংশ মর্যাদার কথা হয়। চোরাইভাবে আসা গরুটির অতিরিক্ত দাম চাওয়ায় ইমরানকে নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক ট্রল হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোটি টাকায়ই বিক্রি হয় ব্রাহমা জাতের ষাঁড়টি।
ইমরানের সিন্ডিকেট চক্র গোপনে কারবার চালালেও প্রকাশ্যে চলে ২০২১ সালে একটি চোরাচালান ধরা পড়ার পর। জালিয়াতির মাধ্যমে আমেরিকা থেকে বিমানভর্তি করে ১৮টি ব্রাহমা জাতের ষাঁড় আনা হয়েছিলো। কিন্তু কাস্টমস সেগুলো আটকে দেয়। ব্রাহমা জাতের গরু আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দেশে মাংস উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের পর সরকার ২০১৬ সালে ব্রাহমা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ইমরানের সঙ্গী সাবেক আইজিপি বেনজীর : দুর্নীতিতে ফেঁসে গেছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। এরইমধ্যে শত শত বিঘা জমি, খামার, বাংলো জব্দ করেছে দুদক। বেনজীর গোপালগঞ্জ ও পার্বত্য জেলাসহ বিভিন্ন জায়গা গরুর খামার করেছেন। সেসব খামার প্রস্তুত করতে ইমরান ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ। আর চোরাকারবারির মাধ্যমে আনা বেশকিছু গরু বেনজীরের খামারেও পাঠিয়ে দেন ইমরান।
এদিকে, সাদিক অ্যাগ্রোতে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। সাবেক পুলিশকর্তা খামারে মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে। আর বেনজীর পুলিশের বিভিন্ন শীর্ষ পদে থাকার সময় সুবিধা নিয়েছেন ইমরান। এক সময় গরু চোরাচালানের মাফিয়া হয়ে ওঠেন ইমরান। অভিযোগ রয়েছে, চোরাচালান বিষয়ে অন্য কোন খামারের মালিক প্রতিবাদ করলে মামলায় ফাঁসিয়ে দেন ইমরান।