১৫৭ বছরের ইতিহাস ভেঙ্গে রেকর্ড গড়লেন সূচনা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৮:৫০:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ মার্চ ২০২৪ ১৭৪ বার পড়া হয়েছে
দেশের প্রাচীনতম শহর কুমিল্লা পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন উন্নীত হয়ে এ পর্যন্ত বিগত ১৫৭ বছরের ইতিহাস ভেঙ্গে প্রথম নারী মেয়র হয়ে নতুন রেকর্ড গড়লেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী ডা. তাহসীন বাহার সূচনা।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপ-নির্বাচনে মেয়র পদে প্রায় ৮৪ শতাংশ কেন্দ্রে এককভাবে জয় পেয়েছেন তিনি। ৮৮টি ভোটকেন্দ্রে অন্য তিন প্রার্থীর চেয়ে তাহসীন বেশি ভোট পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী সাবেক দুইবারের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু মাত্র ১৫টি ভোটকেন্দ্রে অন্যদের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। ভোট পাওয়ার সংখ্যা বিবেচনায় ১০১টি কেন্দ্রে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন মনিরুল হক সাক্কু।
দলীয় সূত্র ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে নির্বাচনে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপের আপ্লুত নবনির্বাচিত মেয়র ডা. তাহসীন বাহার সূচনা। নগরীর উন্নয়ন ও মানুষের সেবায় চেয়েছেন দোয়াও। একই সাথে সাক্ষাতেরও আবেদন জানিয়েছেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী তাকে সাক্ষাতের জন্য দপ্তরে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথোপকথনের এমন ভিডিও এখন ভাইরাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নির্বাচনে জয়লাভ এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথোপকথনের ভিডিও গত দুদিন ধরে সাধারণ ভোটারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের মাঝে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে।
জানা যায়, গত ৯ মার্চ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। এ নির্বাচনে বাস প্রতীকে মহানগর আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. তাহসীন বাহার সূচনা ৪৮ হাজার ৮৯০ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বদ্বি বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু টেবিল ঘড়ি প্রতীকে পেয়েছেন ২৬ হাজার ৮৯৭ ভোট।
অপর দুই প্রার্থী বিএনপি’র বহিস্কৃত নেতা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার ঘোড়া প্রতীকে ১৩ হাজার ১৫৫ ভোট এবং মহানগর আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৫ হাজার ১৭৩ ভোট। এ নির্বাচনে দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮টির মধ্যে ৯৪ হাজার ১১৫ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ভোটগ্রহণের হার ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাবেক মনিরুল হক সাক্কু যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, সে কেন্দ্রেও তিনি পরাজিত হয়েছেন। ফলাফলে তৃতীয় অবস্থানে থাকা বিএনপির বহিষ্কৃত আরেক নেতা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার মাত্র দুটি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন। দুই দফায় নির্বাচন করলেও একটি কেন্দ্রেও জয়ী হতে পারেননি হাতি প্রতীকের প্রার্থী নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাবার (কুমিল্লা সদর আসনের এমপি হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার) সাথে দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ রাজনীতিতে জড়িয়ে পরা ডা. তাহসিন বাহার সূচনারও ব্যক্তিগত ইমেজ কম নয়।
স্থানীয় রাজনীতিকদের অনেকে বলছেন, পারিবারিকভাবে রাজনীতির শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরা ডা. তাহসিন বাহার সূচনা নগরীর নারী ভোটারসহ সাধারণ ভোটারদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। নগর আওয়ামী লীগে আফজল-বাহার দুই ধারায় বিভক্তি থাকলেও গত ৪টি সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ও এবারের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলে এমপি বাহারের ইমেজ ও তার কন্যা প্রার্থী তাহসিন বাহারের ইমেজের কাছে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বিগত সময়ে এই আসনটি বিএনপি’র ঘাটি হিসেবে পরিচিত থাকলেও ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন নির্বাচিত হওয়ার পর পাল্টে যায় সদর আসনের দৃশ্যপট। পর্যায়ক্রমে পরিণত হয় আওয়ামীলীগের শক্তিশালী ঘাটিতে। বিগত ৪টি সংসদ নির্বাচনে টানা জয়লাভের পর কুমিল্লা মহানগর আওয়ামীলীগ সু-সংগঠিত। এছাড়া ডা. সূচনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। পাশাপাশি জাগ্রত মানবিকতা নামে তার একটি সামাজিক সংগঠন রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠার সুবাদে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সাথে গড়ে ওঠ সখ্যতা। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি মানবিক সেবাজনিত কাজেও নগরীতে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তিনি নিজেকে নগর মাতা নয়, নগর কন্যা হিসেবে নারীসহ অসহায় দুঃস্থ মানুষের পাশে থেকে সর্বস্তরের নগরবাসীর সেবায় নিয়োজিত থাকার ঘোষণা দেন। সংসদ সদস্য বাবার ইমেজ ও ডা. তাহসীন বাহার সূচনার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার কারণে এ নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন।
অপরদিকে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের শুরু থেকে টানা দুই দফায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মনিরুল হক সাক্কু। বিগত ২০২২ সালের ১৫ জুন নির্বাচনে প্রয়াত মেয়র আরফানুল হক রিফাতের সাথে পরাজিত হন। ওইসময়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় দল তাকে বহিস্কার করে। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত থাকায় দলটির নেতাকর্মীদের বড় অংশ এবারের নির্বাচনে তার পক্ষে কাজ করেনি। এছাড়া সাক্কুর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও নগরীর কাংখিত উন্নয়ন করতে না পারার ব্যর্থতারও অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া একই দলের বহিষ্কৃত নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সারও গত নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্বিতা করায় স্থানীয় বিএনপির বৃহৎ একটি অংশ তার পক্ষে কাজ করেন। এক্ষেত্রেও সাক্কু ও কায়সারের প্রাপ্ত মোট ভোটেও এগিয়ে রয়েছেন ডা. সূচনা। ভোটের নির্বাচনে সাক্কু-কায়সার একাধিকবার অংশগ্রহণ করলেও ডা. সূচনা ভোটের মাঠের রাজনীতিতে একেবারে নবীন হয়েও বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে বাজিমাত করেছেন। এ নির্বাচনে সাক্কু-কায়সার ও তানিমের প্রাপ্ত মোট ভোট ৪৫ হাজার ২২৫ হলেও তাদের ভোটের চাইতে ডা. সূচনা ৩ হাজার ৬৬৫ ভোট বেশি পেয়েছেন। অর্থাৎ শুধু সাক্কুই নয়, প্রতিদ্বদ্বি ৩ প্রার্থীই ধরাশায়ী হয়েছেন নগরকন্যাখ্যাত ডা. সূচনার কাছে। নির্বাচনের পর গত ২দিন যাবত নগরীসহ জেলাজুড়ে ভোটের এ ব্যবধানের বিষয়টি নিয়ে বেশ সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গন।
যদিও সাক্কু এবং কায়সারের অভিযোগ, নানা কৌশলে ভোটারদের জিম্মি করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন ডা. সূচনা। কায়সার বলেন, আমার ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। তাদের কেন্দ্রের সামনে থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র বাস প্রতীকের ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নবনির্বাচিত মেয়র ডা. তাহসীন বাহার সূচনা বলেন, পরাজিত প্রার্থীরা কখনো তাদের দুর্বলতার কথা প্রকাশ করতে চান না। নগরবাসী দুর্নীতিবাজদের আর কখনো জনপ্রতিনিধির আসনে দেখতে চায় না।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে আমার বিজয় হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রত্যেক নেতাকর্মী আমার জন্য কষ্ট করেছেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে তারা গিয়েছেন। ফলে আমার বিজয় সুনিশ্চিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় আমি কুমিল্লাবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ। সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে নগরবাসীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখব।