বাঁশ ফুল থেকে চাল উৎপাদন : আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন কৃষক সাঞ্জু
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১০:০৬:২৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৪৬ বার পড়া হয়েছে
বাড়ির উঠানে ৫/৬টি ধান ভর্তি বস্তা। দেখে মনে হবে জমি থেকে তোলা প্রকৃত ধানের বস্তা বোঝাই করে রেখেছেন কৃষক। আসলে এগুলো বেইড়া বাশেঁর ফুল থেকে দানা বাঁধা ফল একেবারে ধানের মতই। যার থেকে তৈরি হচ্ছে চাল। রান্না করলেই হয়ে যাচ্ছে ভাত, খাচ্ছেন অনেকেই। নিবারণ হচ্ছে ক্ষুধা।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের পাকাপান গ্রামের সাঞ্জু রায় এমন বিষয়টি উদ্ভাবন করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন এলাকায়। গত কয়েকদিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়লে উৎসুক কৌতুহল জনতার আগমনে সরব হয়ে উঠেছে পাকাপান গ্রামটি।বাঁশের ফুল থেকে চাল উৎপাদন করে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন ওই গ্রামের ২৫ বছর বয়সি দিন মজুর সাঞ্জু রায়। আলোচনার কেন্দ্র এখন পাকাপান গ্রামের দরিদ্র কৃষকসাঞ্জু রায়।
জানা যায়, ফুলবাড়ী শহর থেকে ১০ কি.মি. পশ্চিমে এবং দিনাজপুর – ফুলবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের বারাইহাট বাজার থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে পাকাপান গ্রাম। সেই গ্রামের দরিদ্র কৃষক সাঞ্জু রায় । দেশে কয়েক জাতের বাঁশ রয়েছে। এর মধ্যে গ্রাম্য ভাষায় বেইড়া বাঁশথেকে বাঁশের ফুল দানা বেধে হচ্ছে ফল,যা ধানের মতই দেখতে । সেই ফল থেকেইে এখন উৎপাদন করা হচ্ছে চাল। অন্যান্য চালের মতোই বাঁশের ফল সংগ্রহকৃত বীজ ধানের মিলে ভাঙিয়ে তা থেকে চাল তৈরি করা হচ্ছে। বাঁশ ফুলের মাধ্যমে উৎপাদিত এই চাল দিয়ে ভাত,রুটি, খিচুড়ি, পায়েশ,পিঠা এবং আটা বানিয়ে নানা ধরনের খাবার বানিয়ে খাওয়া হচ্ছে। যা অত্যন্ত সুস্বাদু বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। উৎপাদিত এই চাল ৪০ টাকা কেজি দরে অনেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এই চাল রোজগারের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে অত্র এলাকায়।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরেপাকাপান গ্রামে সাঞ্জু রায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় উৎসুক জনতার ভিড়। সাঞ্জু রায় বাঁশের ঝাড় থেকে ধান সংগ্রহ করে সেসব দানাদার বীজগুলো পরিচর্চা করছে। সেগুলো রোদে শুকিয়ে চালের মিলে ভাঙাবেন। বাড়ির উঠনে প্রস্তুতকৃত এমন কয়েকটি বীজের বস্তা রেখেছেন। কিছু চাল ভাঙিয়ে রেখেছেন। তার মা সাবিত্রী রায় (৪৬) কুলো দিয়ে ঝাড়ছেন।গুড়ো থেকে চাল আলাদা করছেন।বাবা সিমল চন্দ্র(৫০) আগুন্তকদের সাথে কথা বলছেন। গ্রামের অনেকেই সেসব চাল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বাঁশের ফুল থেকে চাল উৎপাদন করার বিষয়টি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
পাকাপান গ্রামের বিধান চন্দ্র রায়,সাহানুর রহমান ,মিনতি রানী, লিপি রানী বলেন, পাকাপান-ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে ১৫/২০ টিএই বাঁশের থোপ আছে। সেই বাঁশের ফুল থেকে চাল সংগ্রহ করার বিষয়টি আমারা প্রথমে বিশ্বাস করিনি।ভেবেছি সাঞ্জু এসব কি করছে? পরে তার এই চাল তৈরি এবং খেয়ে আমরা বুঝতে পেরেছি সে একটি ভালো কিছু করেছে। বর্তমানে তার এই উৎপাদিত চাল অনেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে গবেষণার জন্যও এ গ্রামে আসছে।
অভাবি সংসার,ফসল উঠতে এখনো ১ মাস বাকি বলতে বলতে সাঞ্জু রায় জানালেন, আমাদের পাকাপান গ্রামে এবং আশপাশের গ্রামে বেশকিছু বেইড়া বাঁশ-এর থোপ(বাগান) রয়েছে।কিছুদিন আগে পাশের গ্রামে কাজ করতে গিয়ে কাজের ফাঁকে কালি চন্দ্র রায় (৭০) নামে একজন পরিচিত ব্যক্তি আমাকে বাঁশের ফুল থেকে চাল সংগ্রহ করে খাওয়া যায় এমন কথা জানায়। তার কথামত আমি সেগুলো সংগ্রহ করে প্রথমে নিজে খাই, ভালো লাগলে এরপর থেকে তা সংগ্রহ করে যাচ্ছি। এতে নিজেদের খাবারের চাহিদাও প‚রণ হচ্ছে, পাশাপাশি এই চাল ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছি।কষ্টসাধ্য এই কাজটিকরতে কাটাঁর আঘাত সইতে হয়। ১৫/ ২০ কেজি বীজ সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে ভাঙগিয়ে চাল করলে প্রচলিত ধানের সমপরিমাণ চাল হয়। এই মৌসুমে কাজ না থাকায় রোজগারের একটি পথ তৈরি হওয়ায় আমি অত্যন্ত খুশি।
ইউএনও মীর মো. আল কামাহ তমাল বলেন,আমি কৃষি অফিসারকে বলেছি।স্থানটি পরিদর্শন করে বাঁশের ফুল থেকে দানা বেধে যে চাল উৎপাদন হচ্ছে তা যথোপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করতে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার বলেন,স্থানটি পরিদর্শন করেছি। ৫০/৬০ বছর পরে একবার ফুলদিয়ে এই বাঁশ মারা যায়। বাঁশের ফুল থেকে দানা হওয়ার যে বিষয়টি সম্প্রসারণ হবে কি নাএটি গবেষণার বিষয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোন কৃষি পণ্য সার্টিফাই করলে তখন আমরা সেই বিষয়ে সম্প্রসারণের কাজ করি।ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অবহিত করা হয়েছে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আঞ্চলিক কার্যালয় রংপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রকিবুল হাসান এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, অনেক প্রজতির বাঁশ আছে। এক প্রজাতির বাঁশের ফুল থেকে চাল উৎপাদন হয় ,সেটি অনেক পুষ্টি সমৃদ্ধ। তবে ফলনটি সময় সাপেক্ষের ব্যাপার। বিষয়টি নিয়ে আমরা শিঘ্রই গবেষণার কাজ শুরু করবো।
দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য বিজ্ঞান ও পুষ্টি বিভাগের চেয়ারম্যানঅধ্যাপক এন এইচ এম রুবেল মজুমদার বলেন, ১৬৪৪ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত চায়নাতে এ ধরনের বীজের প্রচলন ছিল। এই চালটি পুষ্টি সমৃদ্ধ হওয়ার কথা। ক্ষতিকর কোনো দিক এখন পর্যন্ত বলা যাচ্ছেনা। তবে এই ফসলটি সময় সাপেক্ষের ব্যাপার এবং সহজে উৎপাদনশীল নয়। ক্যারালাতে এটা নিয়ে অনেক প্রমোশন হচ্ছে।