বনের জমি দখল করে দেড় শতাধিক কারখানা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৫:৫২:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ মে ২০২৪ ৮৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেড( বিবিএস) কেবল। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি এলাকায় অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। কারখানা নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালে গাছপালা কেটে সাতখামাইর ফরেস্ট বিটের তেলিহাটি মৌজার আরএস ২৯২৩, ২৯২৪ ও ২৯২৫ দাগের১.৬১ একর সংরক্ষিত বনের জমি দখল করে এই প্রতিষ্ঠানটি । দখল করা ওই জমির বর্তমান বাজারমূল্য কমপক্ষে আড়াই কোটি টাকা ।দখল করা ওই জমি এখনও উদ্ধার করতে পারেনি বন বিভাগ ।
এরমধ্যে নতুন করে কারখানার মূল ফটকের সামনে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. হাসনাইন ওরফে হাসান বনের জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন। আর এই মার্কেট থেকে প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া তুলছেন । অপরদিকে, গাজীপুর সদরের নলজানী এলাকার অভিজাত ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার মাসিক আয় কোটি টাকারও বেশি । শীত, গ্রীষ্ম, হরতাল- অবরোধেও এই রিসোর্টের ভিলা খালি থাকে না । ৯-১০ বছর আগে নির্মাণের সময় ভাওয়াল রিসোর্টের পাশে থাকা সংরক্ষিত বনের বাড়ইপাড়া মৌজার এসএ সিএস ৩, ২৭৯ ও ২৭১ দাগের৩.৬৮ একর জমি দখল করে নেয় প্রতিষ্ঠানটি । এ ঘটনায় বন বিভাগ গ্রিনটেক রিসোর্টের দখল থেকে জমি উদ্ধারের জন্য গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে উচ্ছেদ মামলা করে । কিন্তু সেই জমি এখনো উদ্ধার হয়নি ।
এভাবে গাজীপুরের সংরক্ষিত বনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা কারখানা, খামার, আলিশান রিসোর্ট, পিকনিক ও শুটিং স্পট নির্মাণ করে বছরে শতকোটি টাকার বাণিজ্য করছে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান ।
ব্যক্তিগত প্রভাবখাটিয়ে এবং কতিপয় অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যক্তিগত জমির সাথে থাকা বনের জমি দখল করে গড়ে তোলা হয় এসব প্রতিষ্ঠান । সংরক্ষিত বনে বা বন ঘেঁষে তৈরি করা এসব প্রতিষ্ঠানের নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র । বন বিভাগের তালিকা অনুযায়ী, গাজীপুরের শ্রীপুর, কালিয়াকৈর ও সদর উপজেলায় ১২ হাজার ৩২১ একর বনের জমি অবৈধ দখলেচেলে গেছে । এরমধ্যে ১৭৪টি প্রতিষ্ঠানের দখলে ৫০০ একর জমি । গত এপ্রিল মাসে বন বিভাগ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে ৮.৭৯ একর বনভূমি ।
অবশিষ্ট ভূমি রিসোর্ট, বাড়িঘর- দোকানপাট, হাটবাজার ও কৃষিজমি হিসেবে দখল করা হয়েছে । ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িঘর তৈরি করে ২৩ হাজার ব্যক্তি দখল করেছে ১০ হাজার একরের বেশি বনভূমি । এতে বনভুমি উজাড় হয়ে হুমকির মুখে পড়েছে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য । অথচ এই আগ্রাসন ঠেকাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বন বিভাগের । বরং নানা ফন্দিতে নতুন করে দখল হচ্ছে বনভূমি ।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, শ্রীপুরে ধনুয়া মৌজায় আরএকে সিরামিকস চার একর, রশোওয়া স্পিনিং মিল চার একর, ডিবিএল সিরামিকস আট একর, অটো স্পিনিং মিলস২.২০ একর, সাতখামাইর মৌজায় আকন্দ গার্ডেন ১৬ একর, রিফাত ব্যাগ ২৫ শতক, পটকা মৌজায় ট্রেড ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন৭.৬৪ একর, কেওয়া মৌজার মিতা টেক্সটাইল২.২০ একর, মেঘনা কম্পোজিট ৪০ শতাংশ, জোবায়ের স্পিনিং এক একর, ওমেগা সুয়েটার এক একর, সোলার সিরামিকস ৯০ শতাংশ, ইকো কটন৪.৮৬ একর, ভাওয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ দুই একর, অনটেক লিমিটেড৪.৯৪ একর, হাউআর ইউ টেক্সটাইল এক একর, অরণ্যকুটির২.২২ একর, উইষ্টেরিয়া টেক্সটাইল৫.৩৩ একর, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল দুই একর, এপেক্স নিট কম্পোজিট১১.৬২ একর, টেপিরবাড়ি মৌজায় ডিবিএল গ্রুপ ছয় একর, গ্রেটওয়াল সিরামিকস৭.৩৮ একর,তেলিহাটি মৌজায় কুঞ্জু বিথি এক একর, আলিফ অটো ব্রিকস ৭০ শতাংশ, টেপিরবাড়ী মৌজায় চায়না বাংলা প্যাকেজিং এক একর, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যালস ৭৬ শতাংশ, এইচ এস অ্যাগ্রো দেড় একর, রেক্স অটো ব্রিকস এক একর ৭০ শতাংশ, টেংরা মৌজায় শিশুপল্লী প্লাস সাড়ে ১২ একর, ওয়ারবিট স্টিল বিল্ডিং দুই একর ও মম পোলট্রি ৭০ শতাংশ বনের জমি দখল করেছে ।
এছাড়া পেলাইদ মৌজায় সিসিডিভি পাঁচ একর, মাওনা মৌজার মনো ফিড২.২৫ একর, সাইটালিয়া জামান পোলট্রি দুই একর,এইচ পাওয়ার লিমিটেড ৩৩ শতাংশ, বিবিএস কেবল, হোম ডিজাইন১.২২ একরদি সোয়েটার, ইকো কটন মিলস, সিটিসেল লিমিটেডও বনের জমি দখল করেছে ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুর সদর উপজেলায় বনভূমি দখলে সবচেয়ে এগিয়ে পারটেক্স গ্রুপ । পারটেক্স কটন লিমিটেড সদর উপজেলার ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান রেঞ্জের বাহাদুরপুর মৌজায় সিএস ২৫৪, ২৮৯, ২৯৪ ও ৩০০ নম্বর দাগে১১.৬৭ একর, পারটেক্স হোল্ডিংস লিমিটেড একই মৌজার সিএস ২০৮, ৫৮৫, ২০৮ ও ৫৮৬ নম্বর দাগে৫.০৯ একর, আম্বার ডেনিম লিমিটেড আড়াইশ প্রসাদ মৌজায় আরএস ৮ থেকে ১৮ এবং ২৮ থেকে ৩২ নম্বর দাগে২৬.২৪ একর মিলিয়ে ৪৩ একর বনভূমি দখলে রেখেছে । তবে এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি পারটেক্স গ্রুপের কোনো কর্মকর্তা ।
মণিপুর এলাকায় বোকরান মণিপুর মৌজায় সিএস ৪২৮ ও ৫৯৮ নম্বর দাগে৬.৫৭ একর সংরক্ষিত বনভূমি দখল করেছে সান পাওয়ার সিরামিকস লিমিটেড । এসব বনভূমি উদ্ধার করতে ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১৩ সালে উচ্ছেদ মামলা করা হয় ।
বনভূমি দখল প্রসঙ্গে সান পাওয়ারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেলিম ভূঞা বলেন, ‘ কারখানার জমির এসএ ও আরএস রেকর্ড আমাদের নামে । কিন্তু শুধু গেজেটে নাম থাকায় বন বিভাগ ওই জমি তাদের দাবি করছে । কারখানাটি বিদেশি বিনিয়োগে স্থাপিত । বনের দাবি করা জমির সমপরিমাণ জমি অন্যত্র কিনে বনায়ন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল । কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি ।
বোকরান মণিপুর মৌজায় ফু- ওয়াং ফুড ও সিএস ৫৯৮ নম্বর দাগে ফু- ওয়াং সিরামিকের দখলে ৪.৪০ একর সংরক্ষিত বনভূমি। বন বিভাগ ২০০৭ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উচ্ছেদ মামলা করে । কিন্তু দায়সারা মামলা হওয়ায় এসব জমি উদ্ধার হয়নি । ফু- ওয়াং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম এসব বিষয়ে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের দখলে বনের কোন জমি নেই ।
এ ছাড়া হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, প্যানাস অটোক্রিয়েশ গার্মেন্টস, ম্যাগডোনালস বাংলাদেশ, বেন্টলী সুয়েটার, ওয়ান্ডার ল্যান্ড টয়েস, ওয়ান ডেনিম, এনএজেড গার্মেন্টস বাংলাদেশ, ওয়ান স্পিনিং মিলস,শরীফ বাড়ি খামার ও রেস্ট হাউস, এমআই ইয়ার্ন ডাইং, ইপিলিয়ন স্টাইল, এটলাস ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, বেন ফিক্সস্টীল বিল্ডিং ডেভেলপমেন্ট, এবি সিদ্দিক পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ, এসএম নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ, বিডি কালেকশন,তিতাস স্পিনিং, বাংলাদেশ মেইজপ্রডাক্ট, ইভিল টেক্স, বেঙ্গল গার্মেন্টস, মাসকাত পোলট্রি ফার্ম, মালা পোলট্রি ফার্ম, টিএস ট্রান্সফরমার, ন্যাশানাল ফিড, লিথি গ্রুপ, প্যারাগন পোলট্রি, মডার্ন ফিড, স্কিন গ্রাফ, গর্ডন স্টিল মিলস, মোশারফ কম্পোজিট, আর্টিসান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, প্যাকলাইন, বিটি লিমিটেড, কুইন্স পোলট্রি ফার্ম লিমিটেড, মিলেনিয়াম স্টিল মিলস লিমিটেড,অমনী অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স, রেডিয়াম এক্সেসরিজ, ঢাকা ফিশারিজ, নির্জনা অ্যাপারেলস, ইনডেক্স কনস্ট্রাকশন, গোলাম কিবরিয়া মৎস্য খামার,নেসলে বাংলাদেশ এবং আদি অ্যাগ্রো ফার্মের সাহাবা ইয়ার্ন, গিভেন্সি ডেনিমস, খোরশেদ আলম অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স, বেঙ্গল হরিকেন ডাইং প্রিন্টিং লিমিটেড, এটিআই সিরামিকের দখলে রয়েছে কোটি কোটি টাকার বনভূমি ।
কালিয়াকৈর সোহাগ পল্লী রিসোর্ট, চন্দ্রা বিটের কালামপুর এলাকার রাঙ্গামাটি ওয়াটার ফ্রন্ট ও চন্দ্রার শিল্পী কুঞ্জ, কোকোলা ফুড প্রডাক্টস, কৌচাকুড়ি মৌজায় সিএস ৯৪২ নম্বর দাগে ১৫.০৫ একর বনের জমিতে ঘরবাড়ি বানিয়ে দখলে রেখেছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে এসব জমি উদ্ধারে ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে উচ্ছেদ মামলার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, গাজীপুরে বনের হাজার হাজার একর জমি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে জবরদখল করা হয়েছে । বন বিভাগ উচ্ছেদ মামলা করলেও নানা বিভিন্ন কারণে অভিযান এগোয়নি। বন বিভাগের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়নি জোরালো উদ্যোগ। গত ১৭ এপ্রিল থেকে উচ্ছদ অভিযান শুরু হয়েছে । শ্রীপুর ও সদর উপজেলায়৮.৭৯ একর বনভূমি উদ্ধার হয়েছে । অভিযান অব্যাহত থাকবে । ’
বন বিভাগের বক্তব্য:
বিবিএস কেবলের বনভূমি দখল প্রসঙ্গে শ্রীপুর ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, বনভূমি দখলে বন বিভাগের নতুন যে তালিকা করা হয়েছে তাতে বিবিএস কেবলস’র নামও রয়েছে । উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে । শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চাণিয়ে জমি দখলমুক্ত করা হবে।
বনভূমি দখল প্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুল হোসেন বলেন, কন বিভাগের এসব জমি অনেক আগেই দখল হয়েছে । গত কয়েক বছরে নতুন করে কোন জমি দখল হয়নি । দখল হওয়া শতাধিক বিঘা জমি উদ্ধার করে বনায়ন করেছে বন বিভাগ। এছাড়া দখল করা জমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সাথে বৈঠক হয়েছে । যৌথভাবে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে । পর্যায়ক্রমে দখল হওয়া সব জমি উদ্ধার করে বনায়ন করা হবে ।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শারমীন আক্তার বলেন, দখল হওয়া বন বিভাগের জমি উদ্ধারের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে উচ্ছেদ মামলার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে । তালিকা অনুযায়ী উচ্ছদ কার্যক্রম চলছে । কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না ।