৯ মাত্রার পর্যন্ত ভূমিকম্পের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:২৯:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৫ ৯৩ বার পড়া হয়েছে
অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছরই আমাদের জীবন, সম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান এসব দুর্যোগের অন্যতম কারণ। নতুন করে এই তালিকায় যোগ হয়েছে ভূমিকম্প। সাম্প্রতিক সময়ে হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূকম্পন অনুভূত হলেও একসময় এ অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটি রেখা কল্পনা করা যায়, এলাকাটি হচ্ছে দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল। এ দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্বে অবস্থিত বার্মা প্লেট, পশ্চিমে অবস্থিত ইন্ডিয়ান প্লেট। এর সংযোগস্থলের উপরের ভাগটি অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মণিপুর, মিজোরাম পর্যন্ত অঞ্চলটি ‘লকড’ হয়ে আছে। অর্থাৎ এখানে শক্তি জমা হয়ে আছে।
এদিকে, শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ১০ট ৩২ মিনিটে ঢাকাসহ সারাদেশে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরেরর ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছেন। ঢাকা থেকে ৪৮২ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে মিয়ানমার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল।
এর আগে গত ২ ডিসেম্বর ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। তারও আগে গত অক্টোবরে ৫.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল দেশে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর নরসিংদী অঞ্চলে ৪ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প হয়, যা রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকাতেও অনুভূত হয়। তার আগে ১৪ আগস্ট সিলেট লাগোয়া বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও দিনাজপুর অঞ্চলই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
এমেই ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে দশ মাসে অন্তত ১২টি ভূমিকম্প হয়েছে। যার অধিকাংশের উৎপত্তিস্থল দেশের অভ্যন্তরে অথবা আশপাশে। ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা নেই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ান এবং বার্মিজ-এ তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই ঘন ঘন এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এ দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে, যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আগে হোক বা পরে, এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। আর সেটাই জানান দিচ্ছে এই ছোট ভূমিকম্পগুলো।
৮ দশমিক ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্পের আশংকা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে, যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর সৈয়দ হুমায়ূন আখতার ভূমিকম্পের এই উৎপত্তিস্থলকে সাবডাকশন জোন (সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, এই জোনে যে বিপুল শক্তি প্রায় হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে আছে। তাতে যেকোনো সময় ৮ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ছোটখাটো ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ।
তিনি বলেন, আমাদের এখনো সময় রয়েছে পরিকল্পনা নেয়ার। সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে সরকার যে পরিকল্পনা নিচ্ছে, সেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। সেটাতেও কিছুটা ভুল আছে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের পরবর্তী উদ্ধারকাজের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতি যেন না হয়, তার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ভূমিকম্প হলে কোথায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে, কোথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসক দল দ্রুত পাঠাতে হবে, কোন জায়গাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেগুলো নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা দেখছি না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে কোথায় ভূমিকম্প হয়েছে। অর্থাৎ ভূমিকম্প যে জায়গায় হয়েছে, তার থেকে তার আশেপাশে জনবহুল এলাকা কতদূর। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকম্প মাটির কত গভীরে হয়েছে এবং কোন মাত্রায় হয়েছে। এই তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ক্ষয়ক্ষতি। দেশের ৩০ বা ৪০ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংগুলো সাধারণত ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল করে বানানো হয়। ওইসব বিল্ডিংয়ের জন্য ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প কোনো বিষয় না। নরমালি ২ বা ৩ অথবা ৫ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংগুলো ৭ মাত্রা ভূমিকম্প সহনশীল করেই বানানো হয়। তবে পুরানো বিল্ডিং বা ডোবা ভরাট করে যে বিল্ডিং করা হয়, ওই বিল্ডিংগুলো এতোটা সহনশীল করে করা হয় না।