বেসরকারি হাসপাতালে গলাকাটা বাণিজ্য, ভুল রিপোর্টে মৃত্যু!
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৫:৫০:৪৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৩ বার পড়া হয়েছে
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনই চিকিৎসাসেবা পেতে ভিড় করছেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত লাখ লাখ রোগী। রোগ নির্ণয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের পরামর্শে বিপুল অর্থ ব্যয় করে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানা পরীক্ষা করছেন। এরপরও মিলছে না কাঙ্কিত সেবা। দেশের নামি-দামি হাসপাতালগুলোতে রোগ নির্ণয়ের উন্নতমানের যন্ত্রপাতি থাকলেও অনেক সময় ভুল রিপোর্টে সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে মৃত্যুর মুখে পড়ছেন রোগীরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিল রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। ফলে অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে বিদেশে ছুটে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন বাস্তবতায় চিকিৎসা নিতে প্রতি বছর বিদেশে যাচ্ছেন প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি। যাদের এ খাতে ব্যয় হচ্ছে অন্তত ৪৮ হাজার কোটি টাকা। রোগীদের এমন তীব্র চাপ সামাল দিতে বিদেশি কয়েকটি হাসপাতাল ঢাকায় তাদের দপ্তর খুলেছে। যারা রোগী ভাগিয়ে নিতে এজেন্সির হয়ে কাজ করছেন। তাদের সহযোগিতা করছেন দেশে অবস্থান করা সুবিধাভোগী একদল চিকিৎসক। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা ব্যবস্থায়। এর ফলে আস্থার সংকটে ধুঁকছে দেশের চিকিৎসা খাত। বুধবার ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
দূরারোগ্যব্যাধিতে আক্রান্ত সুমনাকে। ভুক্তভোগী সুমনা জানান, আট বছর আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। শুরু হয় দেশের এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি। তার দাবি, চিকিৎসকদের একের পর এক ভুল চিকিৎসায় ক্যান্সারের বিস্তার ঘটেছে তার শরীরে। শেষ পর্যন্ত আস্থা হারিয়ে ছুটতে হয় ভিনদেশে।
সুমনা বলেন, যে চিকিৎসকের কাছে আমি ভুল চিকিৎসা নিয়েছি সেক্ষেত্রে কিন্তু তাকে আমরা ধরিনি বা তার সাথে তর্কও করিনি। রাজধানীর ব্যয়বহুল এভারকেয়ার হাসপাতালে মেডিসিনের ডাক্তার দেখাচ্ছি ব্লাডে ইনফেকশনের জন্য, উনি আমাকে বেশ কয়েকটা টেস্ট দিলেন। সেই টেস্টের নমুনাও দিলাম। তখন চিকিৎসককে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কয়দিন পর আমি রিপোর্ট পাব? যেহেতু আমি খুবই অসুস্থ ছিলাম। উনি আমাকে বললেন, অলমোস্ট ১৫ থেকে ২০ দিন লাগবে। আমাকে জানালেন, স্যাম্পল যেটা নিয়েছেন, সেটা পরীক্ষা করানোর জন্য ভারতে পাঠানো হবে, সেখানের ল্যাব থেকে টেস্ট করে তারপর এখানে আসবে। এতদিন সেই রিপোর্টের অপেক্ষায় আমাকে থাকতে হবে।
জানা যায়, গত ১০ বছরে সুমনার মতো বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশি রোগী বেড়েছে ৮ গুণ। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়। প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন ২৭ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি রোগী। যাদের এ খাতে ব্যয় করতে হচ্ছে ৪৫০ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসার বেশিরভাগের গন্তব্য ভারতে। দেশটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মেডিক্যাল ভিসা দেওয়া হয়েছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ৬৭ বাংলাদেশিকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভিসা দেওয়ার হার বেড়েছে প্রায় ৪৭.৯ শতাংশ। কলকাতার নিউমার্কেট, মুকুন্দপুর অঞ্চলের বেসরকারি হাসপাতালেই বেশি ভিড় করেন বাংলাদেশিরা। বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বহনে অসামর্থ্য রোগীদের শেষ ভরসা দেশের সরকারি হাসপাতাল। অথচ সেখানেই সেবার মানে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো খরুচে হলেও সেবার তুলনায় মনোযোগ বেশি বাণিজ্যিকীকরণেই। যে কারণে ব্যক্তি খাতে চিকিৎসার খরচ বেশি থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসা নিতে যাওয়া এক বাংলাদেশি বলেন, আমরা যেন ভালো চিকিৎসা পাই সেজন্য আমরা ভারতে গিয়েছি। সেখানে চিকিৎসার খরচও কম পড়ে। রোগীদের চাপ বেশি থাকায় ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের কয়েকটি হাসপাতাল তাদের একটি চক্র দপ্তর খুলেছেন ঢাকায়। মাঝেমধ্যে সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমেও বিদেশি চিকিৎসকদের ঢাকায় অবস্থান ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে রোগীদের আকৃষ্ট করা হয়। যারা মূলত কমিশনের বিনিময়ে রোগীদের বিদেশে পাঠাতে এজেন্সির হয়ে কাজ করছে। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বিদেশি বহু চিকিৎসকের সেবার মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ একাধিক দেশের একটি শক্তিশালী মার্কেটিং নেটওয়ার্ক যুক্ত রয়েছে। অধিকাংশই যারা ভারতে চিকিৎসক হিসেবে তেমন ভালো করেনি। দেশের বহু নামিদামি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা চিকিৎসকদের পক্ষে প্রচুর প্রচার, প্রোপাগান্ডা করে মানুষকে ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। এবং চিকিৎসা নেওয়া হচ্ছে। বিদেশি হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত মুনাফার আশায় রোগীদের সঙ্গে প্রতারণায় আশ্রয় নিয়ে থাকে বলেও মনে করেন এই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, ভারতে চিকিৎসা করালে বাংলাদেশের সমস্ত পরীক্ষা যে ভুল বা ভুয়া সেটা প্রথমেই বলে থাকেন। দ্বিতীয়ত এটা কী চিকিৎসা দিয়েছে, এটা তো কোনো চিকিৎসা না। এ জাতীয় নেতিবাচক মন্তব্য করেন তারা। পরে দেশে আসার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলিয়ে দেখা যায় যে, ওষুধটি বাংলাদেশের ডাক্তার দিয়েছিল, একই গোত্রের বা গ্রুপের সেই ধরনের ওষুধই কিন্তু অন্য কোনো নামে ভারত থেকে দেওয়া হচ্ছে। মূলত দেশি-বিদেশি একেক কোম্পানি একই গ্রুপের ওষুধ বিভিন্ন নামে ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকে। এ বিষয়টি অনেক রোগী বা তাদের স্বজনরা জানেন না বা বোঝেন না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, জটিল রোগ নির্ণয়ে দেশে বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকলেও প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় স্যাম্পল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা অতিষ্ঠ। এ ক্ষেত্রে সেবার পরিধি অজানা অনেকের। এমন না জেনেই বহু রোগী দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন প্রতি বছর।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে কী ধরনের চিকিৎসা পাওয়া যায়, এটা মানুষকে ঠিকমতো জানানোও হয় না। নিটোরে বা এনআইএইচ এ কী কী ধরনের চিকিৎসা করা যায়, কী কী অপারেশন করা হয় এটা মানুষকে জানানোই হয় না। এনআইএইচ এ কী কী চক্ষু চিকিৎসা দেওয়া হয় তা না জেনেই কারো না কারো পরামর্শে উন্নত সেবা পেতে চোখের একটা সমস্যা হলেই রোগীরা ভারতের চেন্নাইয়ে চলে যান।
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে বিপুল ব্যয় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থার শঙ্কট তৈরি করছে। যার পরিবর্তনে স্বাস্থ্যসেবার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন।
ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলী মিয়া বলেন, সুস্থ হওয়ার পরও রোগী আমার জন্য বদদোয়া করে যে, বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক আমার পকেটটা কেটে একদম শেষ করে দিলো। আমরা যদি এই মিউচুয়াল রেসপেক্টের জায়গাটা ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলে রোগীরা কম সুস্থ হয়েও জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেও দোয়া করবে। সংশ্লিষ্ট রোগীদের রোগ নির্ণয়ে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর কারণ ও চিকিৎসা ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে ল্যাব এইড, বিআরবি, স্কয়ার, ইউনাইটেড, অ্যাপোলো, সেন্ট্রাল, শমরিতা, মনোয়ারা, আজগর আলী ও আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালসহ অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কেউই এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।