আদানির ফাঁদে বাংলাদেশ!
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৫:৪৯:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২ বার পড়া হয়েছে
ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ নিয়ে সব চুক্তি বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। গ্রুপটির সাথে করা সব চুক্তি স্বার্থবিরোধী দাবি করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. আবদুল কাইয়ুম বুধবার (১৩ নভেম্বর) রিটটি করেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদনের ওপর শুনানি হবে।
এর আগে গত ৬ নভেম্বর বিদ্যুৎ নিয়ে ভারতের আদানি গ্রæপের সাথে সব চুক্তি বাতিল চেয়ে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। তিনদিনের মধ্যে আদানিকে চুক্তি পুনর্বিবেচনার কার্যক্রম শুরু না করলে হাইকোর্টে রিট করবেন বলেও জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এছাড়া জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে বিস্তারিত রিপোর্ট দেয়ার জন্যও আহবান জানানো হয়। নোটিশের সময় পেরিয়ে যাওয়ায় বুধবার রিট আবেদনটি করা হয়।
২০১৭ সালে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশনায় আদানির সাথে একপ্রকার তাড়াহুড়া করে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হয়। ওই সময় দেশে আমদানি করা কয়লানির্ভর কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়নি। এসব চুক্তির একটি ২০১৭ সালে আদানির সাথে করা ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খÐে আদানির এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মূলত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
এদিকে, আদানি গ্রুপের ৮৫ কোটি ডলার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে বাংলাদেশের। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বকেয়া আদায়ে নভেম্বরের শুরু থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে আদানি। তবে এই কার্যক্রমকে শুধুই বকেয়া আদায়ের পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে নারাজ বিশ্লেষকরা। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। রেল ও সড়কে ভারতীয় ঋণ ও উদ্যোগে চলমান একাধিক প্রকল্পের কাজ আটকে আছে। প্রতিবেশী দেশটির ব্যবসায়ীরা গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসা। সাধারণ ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য পর্যালোচনা করেও বিশ্লেষকদের মতামতের সত্যতা মেলে। আদানির বকেয়ার প্রায় পুরোটাই আগের সরকারের আমলের। গত অক্টোবরে আদানিকে বাংলাদেশ দিয়েছে ৯ কোটি ডলার। যা গত কয়েক মাসের সর্বোচ্চ। তার পরও কমানো হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম বাংলাদেশ সফরের সময় তার ঘনিষ্ঠ দুই ব্যবসায়ী রিলায়েন্স ও আদানির জন্য বিদ্যুৎ ব্যবসার বিষয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলোচনা করেন। মোদির সফরের দুই মাসের মাথায় আদানি পাওয়ারের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের ভেতরেই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার প্রস্তাব ছিল আদানির। তবে সমঝোতার দু’বছর পর ২০১৭ সালে ভারতের ঝাড়খন্ডরাজ্যের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। দীর্ঘমেয়াদি এই চুক্তির পরতে পরতে ছিল অসমতা।
চুক্তিতে এমন অনেক শর্ত আছে, যেগুলোর কারণে ২৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নিয়ে যাবে আদানি। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ তিন মাস পরপর কত বিদ্যুৎ নেবে, তা আগেই ঘোষণা করতে হবে। যদি বাংলাদেশ এর চেয়ে কম বিদ্যুৎ নেয়, তাহলেও ঘোষিত পরিমাণের সমান দাম পরিশোধ করতে হবে। অথচ বাংলাদেশে যেসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সেগুলোর সঙ্গে এমন কোনো শর্ত নেই।
চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে পিডিবি কখনোই ৩৪ শতাংশের নিচে বিদ্যুৎ নিতে পারবে না। কম বিদ্যুৎ নিলে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যত কয়লা ব্যবহার করা হতো, তার দাম ও কয়লা পরিবহন খরচের অর্থ দিতে হতো। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার পরিমাণ, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বেশি ধরা হয়েছে। আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কয়লার সিস্টেমলস ধরা হয়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ; দেশের অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর চুক্তিতে এমন বিধান নেই। দেরিতে বিল পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশের সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা পায়রার বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেই।
গত অর্থবছর আদানির কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে প্রায় ৮১৬ কোটি ৬৬ লাখ ৭৭ হাজার ইউনিট। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পড়েছে ৬ টাকা ৬০ পয়সা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচলন (ওঅ্যান্ডএম) খরচ ১ টাকা। জ্বালানি (কয়লা) খরচ প্রতি ইউনিটের জন্য ৭ টাকা ৫৪ পয়সা। অর্থাৎ আদানির বিদ্যুৎ কেনায় গড়ে ব্যয় হয়েছে ১৫ টাকা ১৪ পয়সা। চুক্তিতে অসম সুবিধার জন্য আদানির ওঅ্যান্ডএম ব্যয়ও অন্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রর চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে।
এদিকে, রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির কয়লার দাম বেশি, মানও খারাপ। অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা কেনায় সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ ছাড় মিললেও আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা পাচ্ছে না পিডিবি। ২০২৩ সালের জুন থেকে এই বছরের জুন পর্যন্ত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার দাম গড়ে পায়রা নিয়েছে ৬ টাকা ৭৪ পয়সা, রামপাল ৭ টাকা ৯২ পয়সা। একই সময়ে আদানির দাম পড়েছে গড়ে ৮ টাকা ১৫ পয়সা।
অর্থাৎ পায়রার চেয়ে ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৪১ পয়সা, রামপালের চেয়ে ২৩ পয়সা বেশি নিয়েছে আদানি। এই হিসাবে ১৫ মাসে শুধু কয়লার দামেই প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নিয়েছে ভারতীয় কোম্পানিটি।
বর্তমানে প্রতি টন ৪ হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির কয়লা ৯০ ডলারে কিনছে আদানি। অন্যদিকে, একই মানের কয়লা পায়রা কিনছে ৬৮ ডলারে। সে হিসাবে প্রতি টনে ২০ থেকে ২২ ডলার বেশি নিচ্ছে আদানি।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ৬০ শতাংশের বেশি কমিয়েছে আদানি। গত ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমানো শুরু করে কোম্পানিটি। ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিচ্ছিল ভারতীয় গ্রæপটি। ৩১ অক্টোবর তা কমে আসে ৫০০ মেগাওয়াটে। পরে অবশ্য তা বেড়ে ৭০০-৭২০ মেগাওয়াট হয়।
এরপর ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করবে আদানি। যদিও কোম্পানিটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন হুমকির কথা অস্বীকার করে বলে, তারা পিডিবির সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তবে ৭ নভেম্বর রাত ৯টার পরই সরবরাহ ৫০০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। গত শনিবার বিকেল ৫টায় আদানি বাংলাদেশকে ৫১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়।
এদিকে সোমবার দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানির বকেয়া পরিশোধে হাসিনা সরকারকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল ভারত সরকার। এই ঋণের ওপর প্রায় দুই শতাংশ সুদ ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল। তবে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আলোচনা ভেস্তে গেছে।