ঢাকা ০৩:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও দখল-ভরাট

ঐতিহ্য হারাচ্ছে মধুপুরের খাল-বিল

নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল
  • সংবাদ প্রকাশের সময় : ১০:৫৫:৩৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলা টাইমস অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি


জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও দখল ভরাটের কারণে ঐতিহ্য হারাচ্ছে টাঙ্গাইলের মধুপুরের খাল-বিলগুলো। দেশীয় প্রজাতির মাছ থেকে শুরু করে জলজ নানা উদ্ভিদ শেওলাসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। এর প্রভাবে সৌন্দর্যও বিলীন হচ্ছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। খাল-বিলের পুটকা পানা হিজল তমালের ডালে ডালে বাসা বেঁধে বাস করা পাখিও আগের মতো দেখা মেলে না। শামুক ঝিনুক শাপলা ঢেফল শিঙগিরাসহ জলজ উদ্ভিদও হারাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও দখল ভরাটের হাত থেকে রক্ষা পেতে বিল-ঝিল, নদী, জলাশয় খনন, ড্রেইজিং করা মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্য অভয়াশ্রম তৈরি মা মাছ পোনাসহ মৎস্য আইন মেনে চলাসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মধুপুর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় বিলের সংখ্যা ৩৬টি। একমাত্র নদীর নাম বংশাই। মোট পুকুরের সংখ্যা ৪৪৪৬টি। খালের সংখ্যা ৫টি। মৎস্য জীবির সংখ্যা ১৬১৭ জন। মধুপুরে মাছের চাহিদা ৫ হাজার ৯৫০ মে.টন। উৎপাদনের পরিমান ৫ হাজার ৬৪৭ দশমিক ৬৩ মে. টন। মৎস্য চাষীর সংখ্যা ৩৩৯৫ জন।

জানা গেছে, মধুপুরের অন্যতম বড় দিঘির নাম সুতানালী দিঘি। এটি শোলাকুড়ি গ্রামে অবস্থিত। এ দিঘিতে প্রতিবছর প্রচুর পরিমানে মাছ চাষ করা হয়। মাটি পানির গুনাগুন ভালো থাকার কারণে মাছের স্বাদও বেশি। উপজেলার সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী একটি বিলের নাম হাওদা বিল। এটি কুড়াগাছা-অরণখোলা ইউনিয়নের মাঝ খান দিয়ে বয়ে গেছে। এ বিলের মাছের স্বাদ ও ঐতিহ্য রয়েছে পুরো টাঙ্গাইল জেলা জুড়ে। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর এটি। খিরনদী এসে মিলিত হয়েছে এ বিলে। আবার এ বিল গোঁজা খাল হয়ে বংশাই নদীতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। এক সময় সারা বছর জুড়ে জল থাকতো এ বিলে। দেশী প্রজাতির নানা মাছে ছিল ভরপুর। বিলের নালায় চৈত্র মাসে পানি থাকার কারণে মা মাছগুলো ডিম পাড়া সুযোগ পেত। পুটকা পানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদে ছিল সজ্জিত। হিজল তমাল গাছ ছিল। গাছে গাছে পাখিরা বসত। শীতকালে অতিথি পাখি আসে এ বিলে। বিলের দু’পাশে কাশফুলে ভরে যেতে। শুধু এ বিলেই নয় এমন পরিবেশ ছিল মধুপুরের বিলগুলোতে।

এখন কালের পরিক্রমায় চাষাবাদ নালা ভরাট ধানচাষে কীটনাশক প্রয়োগসহ বিরূপ প্রভাবে ঐতিহ্য হারাচ্ছে এসব বিল-নদী-নালা ও খাল। এমনটাই জানালেন স্থানীয়রা।

স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তার হোসেন জানান, এবার জাল কিনে মাছ ধরতে পারছে না। খাল বিলে পানি না আসায় মাছ কমে গেছে। সামান্য মাছ ধরে খাওয়া চলছে বলে জানান তিনি।

আব্দুল বাছেদ জানালেন, আগে বর্ষাকালে বৃষ্টি নামলে জাল-জালি নিয়ে পানি নামার ড্রেনে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। তারা রাতেও মাছ ধরতেন। শিং, মাগুও, কই, ডারকিনা, পুটি, চাটার কোন কমতি ছিল না।

শামছুল হক বলেন, এ বিলের মাছ হাট বাজারে নিয়ে গেলে চড়া দামে বেচা যেত। শিং, মাগুর, কই, টেংরা, পুটি, টাকি, বোয়ালসহ নানা ধরনের দেশী মাছ পাওয়া যেত। কার্তিক মাসে পানি কমলে বাওয়া উৎসব করা হতো। নৌকা বাইস হতো বর্ষাকালে এখন আর আগের সেই ঐতিহ্য নেই।

মোতালেব জানান, শীতকালে এসব বিলের মাছ দিয়ে যে কোন তরকারি রান্না করে রেখে দিলে চর্বি জমে থাকতো। মাটির গুণাগুণের কারণে মধুপুরের বিলের মাছগুলো তুলাহীন। এখন আর আগের সেই মাছ, জলজ উদ্ভিদসহ বিলগুলোর ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় মৎসজীবীদের দাবি, মৎস্য সম্পদ রক্ষা, জলজ পরিবেশ, উদ্ভিদসহ খাল খনন, অভয়াশ্রম করা, খাল-নদী-বিলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করা। মাছে ভাতে বাঙ্গালীর প্রিয় খাবার পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলে খাল-বিল ফিরে পাবে হারানো ঐতিহ্য। স্থানীয়রা পাবে দেশী মাছের সমাহার। অবৈধ জাল বন্ধ করতে পারলে মা ও পোনা মাছের যোগান বাড়বে। হবে পুষ্টির চাহিদা পূরণ।

মধুপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান এ বিষয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ও বন্যা হচ্ছে। এ সময়ে পানি কম থাকায় মা মাছ ডিম দিতে পারছে না। অবৈধ জালে মা মাছ ধরা পড়েছে। যে কারণে পোনা মাছ বাড়ছে না। বর্ষা না হওয়ায় খাল-বিলে আগের মতো পানি হচ্ছে না।

তিনি জানান, অভিযান করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধ জাল। এজন্য জনসচেতনতা প্রয়োজন। দেশীয় মাছ রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান এই কর্মকর্তা।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও দখল-ভরাট

ঐতিহ্য হারাচ্ছে মধুপুরের খাল-বিল

সংবাদ প্রকাশের সময় : ১০:৫৫:৩৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪


জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও দখল ভরাটের কারণে ঐতিহ্য হারাচ্ছে টাঙ্গাইলের মধুপুরের খাল-বিলগুলো। দেশীয় প্রজাতির মাছ থেকে শুরু করে জলজ নানা উদ্ভিদ শেওলাসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। এর প্রভাবে সৌন্দর্যও বিলীন হচ্ছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। খাল-বিলের পুটকা পানা হিজল তমালের ডালে ডালে বাসা বেঁধে বাস করা পাখিও আগের মতো দেখা মেলে না। শামুক ঝিনুক শাপলা ঢেফল শিঙগিরাসহ জলজ উদ্ভিদও হারাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও দখল ভরাটের হাত থেকে রক্ষা পেতে বিল-ঝিল, নদী, জলাশয় খনন, ড্রেইজিং করা মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্য অভয়াশ্রম তৈরি মা মাছ পোনাসহ মৎস্য আইন মেনে চলাসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মধুপুর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় বিলের সংখ্যা ৩৬টি। একমাত্র নদীর নাম বংশাই। মোট পুকুরের সংখ্যা ৪৪৪৬টি। খালের সংখ্যা ৫টি। মৎস্য জীবির সংখ্যা ১৬১৭ জন। মধুপুরে মাছের চাহিদা ৫ হাজার ৯৫০ মে.টন। উৎপাদনের পরিমান ৫ হাজার ৬৪৭ দশমিক ৬৩ মে. টন। মৎস্য চাষীর সংখ্যা ৩৩৯৫ জন।

জানা গেছে, মধুপুরের অন্যতম বড় দিঘির নাম সুতানালী দিঘি। এটি শোলাকুড়ি গ্রামে অবস্থিত। এ দিঘিতে প্রতিবছর প্রচুর পরিমানে মাছ চাষ করা হয়। মাটি পানির গুনাগুন ভালো থাকার কারণে মাছের স্বাদও বেশি। উপজেলার সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী একটি বিলের নাম হাওদা বিল। এটি কুড়াগাছা-অরণখোলা ইউনিয়নের মাঝ খান দিয়ে বয়ে গেছে। এ বিলের মাছের স্বাদ ও ঐতিহ্য রয়েছে পুরো টাঙ্গাইল জেলা জুড়ে। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর এটি। খিরনদী এসে মিলিত হয়েছে এ বিলে। আবার এ বিল গোঁজা খাল হয়ে বংশাই নদীতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। এক সময় সারা বছর জুড়ে জল থাকতো এ বিলে। দেশী প্রজাতির নানা মাছে ছিল ভরপুর। বিলের নালায় চৈত্র মাসে পানি থাকার কারণে মা মাছগুলো ডিম পাড়া সুযোগ পেত। পুটকা পানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদে ছিল সজ্জিত। হিজল তমাল গাছ ছিল। গাছে গাছে পাখিরা বসত। শীতকালে অতিথি পাখি আসে এ বিলে। বিলের দু’পাশে কাশফুলে ভরে যেতে। শুধু এ বিলেই নয় এমন পরিবেশ ছিল মধুপুরের বিলগুলোতে।

এখন কালের পরিক্রমায় চাষাবাদ নালা ভরাট ধানচাষে কীটনাশক প্রয়োগসহ বিরূপ প্রভাবে ঐতিহ্য হারাচ্ছে এসব বিল-নদী-নালা ও খাল। এমনটাই জানালেন স্থানীয়রা।

স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তার হোসেন জানান, এবার জাল কিনে মাছ ধরতে পারছে না। খাল বিলে পানি না আসায় মাছ কমে গেছে। সামান্য মাছ ধরে খাওয়া চলছে বলে জানান তিনি।

আব্দুল বাছেদ জানালেন, আগে বর্ষাকালে বৃষ্টি নামলে জাল-জালি নিয়ে পানি নামার ড্রেনে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। তারা রাতেও মাছ ধরতেন। শিং, মাগুও, কই, ডারকিনা, পুটি, চাটার কোন কমতি ছিল না।

শামছুল হক বলেন, এ বিলের মাছ হাট বাজারে নিয়ে গেলে চড়া দামে বেচা যেত। শিং, মাগুর, কই, টেংরা, পুটি, টাকি, বোয়ালসহ নানা ধরনের দেশী মাছ পাওয়া যেত। কার্তিক মাসে পানি কমলে বাওয়া উৎসব করা হতো। নৌকা বাইস হতো বর্ষাকালে এখন আর আগের সেই ঐতিহ্য নেই।

মোতালেব জানান, শীতকালে এসব বিলের মাছ দিয়ে যে কোন তরকারি রান্না করে রেখে দিলে চর্বি জমে থাকতো। মাটির গুণাগুণের কারণে মধুপুরের বিলের মাছগুলো তুলাহীন। এখন আর আগের সেই মাছ, জলজ উদ্ভিদসহ বিলগুলোর ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় মৎসজীবীদের দাবি, মৎস্য সম্পদ রক্ষা, জলজ পরিবেশ, উদ্ভিদসহ খাল খনন, অভয়াশ্রম করা, খাল-নদী-বিলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করা। মাছে ভাতে বাঙ্গালীর প্রিয় খাবার পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলে খাল-বিল ফিরে পাবে হারানো ঐতিহ্য। স্থানীয়রা পাবে দেশী মাছের সমাহার। অবৈধ জাল বন্ধ করতে পারলে মা ও পোনা মাছের যোগান বাড়বে। হবে পুষ্টির চাহিদা পূরণ।

মধুপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান এ বিষয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ও বন্যা হচ্ছে। এ সময়ে পানি কম থাকায় মা মাছ ডিম দিতে পারছে না। অবৈধ জালে মা মাছ ধরা পড়েছে। যে কারণে পোনা মাছ বাড়ছে না। বর্ষা না হওয়ায় খাল-বিলে আগের মতো পানি হচ্ছে না।

তিনি জানান, অভিযান করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধ জাল। এজন্য জনসচেতনতা প্রয়োজন। দেশীয় মাছ রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান এই কর্মকর্তা।