ঢাকা ১২:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিচার বিভাগের হালচাল

এডভোকেট এম কে আহমদ
  • সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৪:৫৫:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৪ ৯৮ বার পড়া হয়েছে
বাংলা টাইমস অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

স্বাধীনতার অনতিকাল পরেই আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রবর্তন করা হয়।

এই সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী,- “(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে” । এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপুর্ন হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷” এই অনুচ্ছেদের অন্যতম উদ্দেশ্য হল আইনের শাসন বা রুল অব ল সুপ্রতিষ্ঠিত করা।


প্রতিটি স্বাধীন, সভ্য, আধুনিক দেশের ন্যায় আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম লক্ষ্য। বাংলাদেশের সংবিধানের এই অন্যতম নীতি আইনের শাসন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র সহ সকল দেশের সংবিধানে গৃহিত ও বহুল প্রচলিত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন মূলত আইনের শাসনের বাস্তব প্রয়োগের উপর র্নিভরশীল। আইন প্রণীত হয় জনগনের কল্যানের জন্য সমাজে ভারসাম্য আনয়নের জন্য, এবং বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের মাধ্যমে সম্পৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আইনের শাসনের প্রধান উদ্দেশ্যে হলো সমাজে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মানুষের কল্যানের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সমাজ বিনির্মানে নিশ্চিত করা ও নিরাপদ ভুমিকা।

এ প্রসঙ্গে আইনের শাসন ধারনার অন্যতম প্রর্বতক ডাইসি বলেছেন যে আইনের শাসনে সমতা থাকা উচিত এবং কোনো ভেদাভেদ না করে সকলকে একই আইন ও আদালতের অধীনে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮, ২৯ এবং ৩১ অনুচ্ছেদে সমতার নীতির এক অসাধারণ বর্ননা আছে যা প্রতিবেশী দেশগুলোর সংবিধানের তুলনায় অনেক অগ্রগামী। এটি অভিসংবাদিত যে আইনের শাসন গনতন্ত্রের অন্যতম উৎস ও অনিবার্য পূর্বশর্ত কিন্তু এই আইনের শাসন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আইনের শাসন ও সুষ্টু গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাস্তবে খুবই অপরিহার্য।


বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিচারক নিয়োগের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপুর্ন। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শের বিধান ছিলো কিন্তু সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর দ্বারা সেই বিধান বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৯৪ সালে প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ না করে যখন ৯ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ করা হয়, তখন প্রধান বিচারপতির আপত্তির প্রেক্ষিতে সুপ্রীমকোর্ট বার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন এবং বলেন যে, ৪র্থ সংশোধনীর পূর্বে ও পরে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করে এসেছেন। এই ক্ষেত্রে একটি কনভেনশন বা রেওয়াজ বহুদিন থেকে চলে আসছে হেতু প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করার সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ফলে সরকার জোরাজুরি করা থেকে বিরত থেকে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন এবং এই ক্ষেত্রে প্রথম বারের মত বিচারপতি নিয়োগের নোটিফিকেশনে প্রধান বিচারপতির সাথে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করার কথা উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে বিষয়টির সঠিকতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির সাথে পরামর্শের বিষয়টি আবারো সন্নিবেশিত করা হয়। উপযুক্ত বিচারকের যোগ্যতা সর্ম্পকে কোন কোন আইন বিশেষজ্ঞ লেখকের অভিমত এই যে, “সকল বিচারকের আইন সম্পর্কিত ধারনা একরকম না থাকতে পারে। যদি কোনো বিচারক মনোজগতে এটি ধারনা করেন যে তার ধারনাটিই চূড়ান্ত তাহলে তার পক্ষে আইনজীবীদের উত্থাপিত যুক্তিতর্ক গ্রহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে বিচারকের সিদ্ধান্ত অজান্তেই বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হতে পারে। তাই সঠিক ও দৃড় সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদার ও ধৈর্যশীল মন নিয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শ্রবণ করাটা একজন বিচারকের সঠিক এবং প্রাথমিক দায়িত্ব। তবে এর মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহন বিষয়টি। সেই সাথে আস্থা বাড়ে বিচারপ্রার্থী মানুষের।”


এই প্রসঙ্গে বোম্বে হাইকোর্ট এর প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চাগলার কথা উল্লেখ করে তাহার কথা এইভাবে বলা হয় যে, “তার আইন বিষয়ে জ্ঞান ছিলো অপরিসীম, বুদ্ধিমত্তায় ছিলেন প্রখর। সাধারণ জ্ঞান বা কমন সেন্স ছিলো তার অতুলনীয়। আদালত কক্ষের ভিতরে বা বাইরে সর্বত্রই তার জ্ঞানের পরিচয় পরিলক্ষিত হতো বলে শোনা যায়। প্রকৃতপক্ষে এটাই হলো একজন বিচারকের শক্তি। আর এই শক্তিই বিচারক ও বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করে।

৬৯ ডিএলআর (এইচসি) ৩১৭ পৃষ্ঠায় একটি উল্লেখযোগ্য রায় প্রকাশিত হয়েছে। ঐখানে ৭টি মানদন্ডের এর কথা উল্লেখ করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম হল বিচারকের বয়স ৪৫ বৎসর হতে হবে এবং আপীল বিভাগে সনদ প্রাপ্তরা অগ্রাধিকার পাবে কিন্ত বাস্তবতা হল যারা হাইকোর্টে সনদ লাভের পর বাস্তবে জেলা আদালতে অনেক দিন প্রাকটিস্ করেন বা করেছেন এবং অনেক দিন বিদেশে অবস্থান করেন তাদের ক্ষেত্রেও বিচারক হিসাবে নিয়োগ পেতে বয়স নূন্যপক্ষে ৫০ বৎসর বয়স হওয়া দরকার। পেশাগত সফলতা ও অন্যান্য যোগ্যতা পযার্প্ত থাকার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ফলাফলের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য করা প্রয়োজন যে বিচারপতি নিয়োগের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে বিশেষভাবে বাস্তব অভিজ্ঞতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ। সাথে সাথে শপথ অনুসারে কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই সকর পক্ষকে পর্যাপ্ত শুনানির সুযোগ দিয়ে ন্যায়ানুগ বিচার করা একজন বিচারকের পরম কর্তব্য। কিন্তু তা সত্তে¡তে বর্তমানে শোনা যায় যে সদ্য সাবেক সরকারের আমলে ক্লাস মেট, ব্যাচ মেট বা বিশেষ কোন দল ও গোষ্টির কেউ কেউ বেশি গুরুত্ত¡ পেয়ে করে থাকে যা শপথ নেবার পর বিচারকের বিচারিক রীতিনীতির পরিপন্থী। তাছাড়া একজন বিচারক কে ব্যক্তি জীবন সৎ, ন্যায়পরায়ণ আইনজ্ঞ ও জ্ঞানপিপাষু হওয়া বা নীয়। সুপ্রীম কোর্ট বার থেকে এখনও বেশিরভাগ বিচারক নিয়োগ করা হয়। একজন বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী প্রতিভা ও নিরপেক্ষতার মানদÐ দেখে তাকে বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। একজন নিরপেক্ষ ও প্রতিভাবান আইনজীবীর বিচারক হওয়া এবং ভালো গুণাবলীর অধিকারী হওয়া দরকার কিন্তু আজকাল শোনা যায় যে এক্ষেত্রে ভাল আইনজীবী হওয়ার চাইতে কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর প্রতি নমনীয় ব্যক্তিগণ বেশি গুরুত্ত¡ পায়। ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার “আইন-ই-আকবরী” গ্রন্থে প্রসঙ্গক্রমে একজন গুনী ব্যক্তির কথা বলতে গিয়ে তাকে উকিলের মতো জ্ঞানবক্ত্বা এবং দরবেশের মতো দৃঢ়চিত্তের কথা উল্লেখ করেন। তাই বিচারক হওয়ার জন্য এই রকম আইনজীবী হওয়া প্রয়োজন। শুধু ভালো আইনজীবী হলে হবে না ভালো শিষ্টাচার etiquette) এবং নৈতিকতার (morality) এবং নৈতিকতার  (morality) অধিকারী হতে হবে। আজকাল দেখা যায় বিচারপতি নিয়োগের পর বা তৎপরবর্তী স্থায়ী করণের পর কারো কারো গ্রæপপৃতি ও গোষ্ঠীপৃতি দেখা যায় বলে গুঞ্জন শুনা যায়। যাহা দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান এবং রীতিনীতি অনুযায়ী কাম্যনয়। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে বিবেচনা করবেন যে বিচারপতি নিয়োগের ফলশ্রæতিতে ন্যায় বিচার বিঘœ না হয় এবং বার ও বেে র ঐতিহ্যবাহী স্বরূপ সু-সম্পর্ক বজায় থাকে।

১৫.০৬.২০২৪ তারিখে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এক শিরোনামে যে “এক যুগেও (বাস্তবায়িত) হয়নি বিচারপতি নিয়োগ আইন” বিচারপতি নিয়োগ আইন ২০১২ খসড়া প্রস্তুত হলেও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি যাহা বিচারপতি নিয়োগের আইন, যাহা আগে হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। এই সর্ম্পকে সুপ্রীম কোর্ট বারের দুইজন সিনিয়র এ্যাডভোকেট ও সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি (সাবেক আইনমন্ত্রী) ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং সুপ্রীম কোট বারের বর্তমান সভাপতি (সাবেক সংসদ সদস্য) ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন চমৎকার অভিমত ও পরামর্শ দিয়েছেন। আমি মনে করি সকল কিছু বিবেচনা করে অতিসত্বর উপরুক্ত ২০১২ সালের আইন বাস্তবায়ন করা উচিত এবং ১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবউদ্দিন আহমেদ (পরর্বতীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট) নিরোপেক্ষ ও সততা যাচাইয়ে সুপ্রীম কোর্ট বারের সহযোগিতায় যেভাবে নিয়োগ প্রদান করিয়া ছিলেন, বিচারপতি নিয়োগে সেইরকম নিয়োগ বার ও দেশবাসী আশা রাখে।     

পূর্বে উল্লেখ করা হইয়েছে, বাংলাদেশ সংবিধানের অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো সমতার নীতি, বার ও বে একে অপরের সর্ম্পূরক এবং পরিপূরক এ বিষয়ে ৩৫ ডিএলআর (এডি) ২৯০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ÒBoth the bar and bench are two arms of the same machinery unless the work done harmoniously justice can not be properly administered” এই জন্য বার ও বেে র সুসর্ম্পক গড়ার লক্ষ্যে এবং সম্মৃদ্ধির জন্য সাম্য ও ন্যায় বিচার একান্ত দরকার। বিচারকার্যে ন্যায় বিচার এবং বিচার সর্ম্পকিত অন্যান্য কার্য যেমন-আইনজীবীদের অধিকার, প্রিভিলেজ ও সকল ক্ষেত্রে সকলের জন্য সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের অনুসারে সমতা নীতির আলোকে অন্যান্য প্রাসাঙ্গিক বিচার বিশ্লেষণ করা বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখে।

অন্যথায় বার ও বেে র সুসর্ম্পকর ঘাটতি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়, বিধায় মাননীয় বিচারকবৃন্ধের প্রতি নিবেদন বর্ণিত রায়, প্রতিষ্ঠিত আইন ও নীতির আলোকে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা বিকাশে ও বির্নিমানে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনধারা উন্নয়নের জন্য সাম্য ও সমতার নীতি অনুসারে সামগ্রিকভাবে বর্ণিত সকল বিষয়সহ ন্যায় বিচারের বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক পরিচিতি : এম কে আহমদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কার্টের একজন এডভোকেট।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

বিচার বিভাগের হালচাল

সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৪:৫৫:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৪

স্বাধীনতার অনতিকাল পরেই আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রবর্তন করা হয়।

এই সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী,- “(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে” । এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপুর্ন হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷” এই অনুচ্ছেদের অন্যতম উদ্দেশ্য হল আইনের শাসন বা রুল অব ল সুপ্রতিষ্ঠিত করা।


প্রতিটি স্বাধীন, সভ্য, আধুনিক দেশের ন্যায় আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম লক্ষ্য। বাংলাদেশের সংবিধানের এই অন্যতম নীতি আইনের শাসন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র সহ সকল দেশের সংবিধানে গৃহিত ও বহুল প্রচলিত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন মূলত আইনের শাসনের বাস্তব প্রয়োগের উপর র্নিভরশীল। আইন প্রণীত হয় জনগনের কল্যানের জন্য সমাজে ভারসাম্য আনয়নের জন্য, এবং বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের মাধ্যমে সম্পৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আইনের শাসনের প্রধান উদ্দেশ্যে হলো সমাজে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মানুষের কল্যানের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সমাজ বিনির্মানে নিশ্চিত করা ও নিরাপদ ভুমিকা।

এ প্রসঙ্গে আইনের শাসন ধারনার অন্যতম প্রর্বতক ডাইসি বলেছেন যে আইনের শাসনে সমতা থাকা উচিত এবং কোনো ভেদাভেদ না করে সকলকে একই আইন ও আদালতের অধীনে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮, ২৯ এবং ৩১ অনুচ্ছেদে সমতার নীতির এক অসাধারণ বর্ননা আছে যা প্রতিবেশী দেশগুলোর সংবিধানের তুলনায় অনেক অগ্রগামী। এটি অভিসংবাদিত যে আইনের শাসন গনতন্ত্রের অন্যতম উৎস ও অনিবার্য পূর্বশর্ত কিন্তু এই আইনের শাসন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আইনের শাসন ও সুষ্টু গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাস্তবে খুবই অপরিহার্য।


বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিচারক নিয়োগের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপুর্ন। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শের বিধান ছিলো কিন্তু সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর দ্বারা সেই বিধান বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৯৪ সালে প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ না করে যখন ৯ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ করা হয়, তখন প্রধান বিচারপতির আপত্তির প্রেক্ষিতে সুপ্রীমকোর্ট বার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন এবং বলেন যে, ৪র্থ সংশোধনীর পূর্বে ও পরে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করে এসেছেন। এই ক্ষেত্রে একটি কনভেনশন বা রেওয়াজ বহুদিন থেকে চলে আসছে হেতু প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করার সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ফলে সরকার জোরাজুরি করা থেকে বিরত থেকে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন এবং এই ক্ষেত্রে প্রথম বারের মত বিচারপতি নিয়োগের নোটিফিকেশনে প্রধান বিচারপতির সাথে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করার কথা উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে বিষয়টির সঠিকতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির সাথে পরামর্শের বিষয়টি আবারো সন্নিবেশিত করা হয়। উপযুক্ত বিচারকের যোগ্যতা সর্ম্পকে কোন কোন আইন বিশেষজ্ঞ লেখকের অভিমত এই যে, “সকল বিচারকের আইন সম্পর্কিত ধারনা একরকম না থাকতে পারে। যদি কোনো বিচারক মনোজগতে এটি ধারনা করেন যে তার ধারনাটিই চূড়ান্ত তাহলে তার পক্ষে আইনজীবীদের উত্থাপিত যুক্তিতর্ক গ্রহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে বিচারকের সিদ্ধান্ত অজান্তেই বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হতে পারে। তাই সঠিক ও দৃড় সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদার ও ধৈর্যশীল মন নিয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শ্রবণ করাটা একজন বিচারকের সঠিক এবং প্রাথমিক দায়িত্ব। তবে এর মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহন বিষয়টি। সেই সাথে আস্থা বাড়ে বিচারপ্রার্থী মানুষের।”


এই প্রসঙ্গে বোম্বে হাইকোর্ট এর প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চাগলার কথা উল্লেখ করে তাহার কথা এইভাবে বলা হয় যে, “তার আইন বিষয়ে জ্ঞান ছিলো অপরিসীম, বুদ্ধিমত্তায় ছিলেন প্রখর। সাধারণ জ্ঞান বা কমন সেন্স ছিলো তার অতুলনীয়। আদালত কক্ষের ভিতরে বা বাইরে সর্বত্রই তার জ্ঞানের পরিচয় পরিলক্ষিত হতো বলে শোনা যায়। প্রকৃতপক্ষে এটাই হলো একজন বিচারকের শক্তি। আর এই শক্তিই বিচারক ও বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করে।

৬৯ ডিএলআর (এইচসি) ৩১৭ পৃষ্ঠায় একটি উল্লেখযোগ্য রায় প্রকাশিত হয়েছে। ঐখানে ৭টি মানদন্ডের এর কথা উল্লেখ করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম হল বিচারকের বয়স ৪৫ বৎসর হতে হবে এবং আপীল বিভাগে সনদ প্রাপ্তরা অগ্রাধিকার পাবে কিন্ত বাস্তবতা হল যারা হাইকোর্টে সনদ লাভের পর বাস্তবে জেলা আদালতে অনেক দিন প্রাকটিস্ করেন বা করেছেন এবং অনেক দিন বিদেশে অবস্থান করেন তাদের ক্ষেত্রেও বিচারক হিসাবে নিয়োগ পেতে বয়স নূন্যপক্ষে ৫০ বৎসর বয়স হওয়া দরকার। পেশাগত সফলতা ও অন্যান্য যোগ্যতা পযার্প্ত থাকার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ফলাফলের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য করা প্রয়োজন যে বিচারপতি নিয়োগের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে বিশেষভাবে বাস্তব অভিজ্ঞতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ। সাথে সাথে শপথ অনুসারে কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই সকর পক্ষকে পর্যাপ্ত শুনানির সুযোগ দিয়ে ন্যায়ানুগ বিচার করা একজন বিচারকের পরম কর্তব্য। কিন্তু তা সত্তে¡তে বর্তমানে শোনা যায় যে সদ্য সাবেক সরকারের আমলে ক্লাস মেট, ব্যাচ মেট বা বিশেষ কোন দল ও গোষ্টির কেউ কেউ বেশি গুরুত্ত¡ পেয়ে করে থাকে যা শপথ নেবার পর বিচারকের বিচারিক রীতিনীতির পরিপন্থী। তাছাড়া একজন বিচারক কে ব্যক্তি জীবন সৎ, ন্যায়পরায়ণ আইনজ্ঞ ও জ্ঞানপিপাষু হওয়া বা নীয়। সুপ্রীম কোর্ট বার থেকে এখনও বেশিরভাগ বিচারক নিয়োগ করা হয়। একজন বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী প্রতিভা ও নিরপেক্ষতার মানদÐ দেখে তাকে বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। একজন নিরপেক্ষ ও প্রতিভাবান আইনজীবীর বিচারক হওয়া এবং ভালো গুণাবলীর অধিকারী হওয়া দরকার কিন্তু আজকাল শোনা যায় যে এক্ষেত্রে ভাল আইনজীবী হওয়ার চাইতে কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর প্রতি নমনীয় ব্যক্তিগণ বেশি গুরুত্ত¡ পায়। ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার “আইন-ই-আকবরী” গ্রন্থে প্রসঙ্গক্রমে একজন গুনী ব্যক্তির কথা বলতে গিয়ে তাকে উকিলের মতো জ্ঞানবক্ত্বা এবং দরবেশের মতো দৃঢ়চিত্তের কথা উল্লেখ করেন। তাই বিচারক হওয়ার জন্য এই রকম আইনজীবী হওয়া প্রয়োজন। শুধু ভালো আইনজীবী হলে হবে না ভালো শিষ্টাচার etiquette) এবং নৈতিকতার (morality) এবং নৈতিকতার  (morality) অধিকারী হতে হবে। আজকাল দেখা যায় বিচারপতি নিয়োগের পর বা তৎপরবর্তী স্থায়ী করণের পর কারো কারো গ্রæপপৃতি ও গোষ্ঠীপৃতি দেখা যায় বলে গুঞ্জন শুনা যায়। যাহা দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান এবং রীতিনীতি অনুযায়ী কাম্যনয়। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে বিবেচনা করবেন যে বিচারপতি নিয়োগের ফলশ্রæতিতে ন্যায় বিচার বিঘœ না হয় এবং বার ও বেে র ঐতিহ্যবাহী স্বরূপ সু-সম্পর্ক বজায় থাকে।

১৫.০৬.২০২৪ তারিখে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এক শিরোনামে যে “এক যুগেও (বাস্তবায়িত) হয়নি বিচারপতি নিয়োগ আইন” বিচারপতি নিয়োগ আইন ২০১২ খসড়া প্রস্তুত হলেও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি যাহা বিচারপতি নিয়োগের আইন, যাহা আগে হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। এই সর্ম্পকে সুপ্রীম কোর্ট বারের দুইজন সিনিয়র এ্যাডভোকেট ও সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি (সাবেক আইনমন্ত্রী) ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং সুপ্রীম কোট বারের বর্তমান সভাপতি (সাবেক সংসদ সদস্য) ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন চমৎকার অভিমত ও পরামর্শ দিয়েছেন। আমি মনে করি সকল কিছু বিবেচনা করে অতিসত্বর উপরুক্ত ২০১২ সালের আইন বাস্তবায়ন করা উচিত এবং ১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবউদ্দিন আহমেদ (পরর্বতীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট) নিরোপেক্ষ ও সততা যাচাইয়ে সুপ্রীম কোর্ট বারের সহযোগিতায় যেভাবে নিয়োগ প্রদান করিয়া ছিলেন, বিচারপতি নিয়োগে সেইরকম নিয়োগ বার ও দেশবাসী আশা রাখে।     

পূর্বে উল্লেখ করা হইয়েছে, বাংলাদেশ সংবিধানের অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো সমতার নীতি, বার ও বে একে অপরের সর্ম্পূরক এবং পরিপূরক এ বিষয়ে ৩৫ ডিএলআর (এডি) ২৯০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ÒBoth the bar and bench are two arms of the same machinery unless the work done harmoniously justice can not be properly administered” এই জন্য বার ও বেে র সুসর্ম্পক গড়ার লক্ষ্যে এবং সম্মৃদ্ধির জন্য সাম্য ও ন্যায় বিচার একান্ত দরকার। বিচারকার্যে ন্যায় বিচার এবং বিচার সর্ম্পকিত অন্যান্য কার্য যেমন-আইনজীবীদের অধিকার, প্রিভিলেজ ও সকল ক্ষেত্রে সকলের জন্য সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের অনুসারে সমতা নীতির আলোকে অন্যান্য প্রাসাঙ্গিক বিচার বিশ্লেষণ করা বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখে।

অন্যথায় বার ও বেে র সুসর্ম্পকর ঘাটতি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়, বিধায় মাননীয় বিচারকবৃন্ধের প্রতি নিবেদন বর্ণিত রায়, প্রতিষ্ঠিত আইন ও নীতির আলোকে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা বিকাশে ও বির্নিমানে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনধারা উন্নয়নের জন্য সাম্য ও সমতার নীতি অনুসারে সামগ্রিকভাবে বর্ণিত সকল বিষয়সহ ন্যায় বিচারের বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক পরিচিতি : এম কে আহমদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কার্টের একজন এডভোকেট।