ঘটনা ধামা চাপার চেষ্টা, ১১ দিনেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়নি
গুলিতে নয়, ইটপাটকেলের আঘাতে আবু সাইদের মৃত্যু!
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৮:২৪:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ ১১০ বার পড়া হয়েছে
সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশ কর্তৃক টার্গেট করে গুলি করে হত্যার অভিযোগ নিয়ে রংপুরসহ দেশব্যাপি তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঘটনার ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্য এবং গুলি করার হুকুম দাতার বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। উল্টো আবু সাইদ হত্যাকারীদের রক্ষা করতে পুলিশ নিজেরাই বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে সেখানে ইট পাটকেলের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
শনিবার (২৭ জুলাই) মামলার এজাহার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি মাসের ১৬ জুলাই দুপুরে বেরোবির শিক্ষার্থী আবু সাইদকে মাত্র ২০ ফুট দুর থেকে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওইদিন গোপনে মেট্রোপলিটান তাজহাট থানায় বেরোবি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই বিভুতিভুষন রায় বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। যার মামলা নম্বর ৬ তারিখ ১৬/০৭/২৪ইং।
মামলার এজাহারে কারো নাম উল্লেখ না করা হলেও বলা হয়েছে, অজ্ঞাত ২/৩ হাজার ছাত্র নামধারী দুবৃর্ত্ত ও জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসী।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাইদ দু’পক্ষের ইট পাটকেলের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে। তাকে যে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেই বিষয়টি পুরোপুরি চেপে যাওয়া হয়েছে। এই এজাহার করে গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্য এবং গুলি করার নির্দ্দেশদানকারী মেট্রোপলিটান পুলিশের একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারকে হত্যার দায় থেকে বাঁচাতে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ বলে অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক , শিক্ষার্থী ও প্রত্যাক্ষদর্শীরা।
তারা বলেছেন, পুলিশ যে বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাইদকে টার্গেট করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি করেছে, যার পুরো ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশে বিদেশে ভাইরাল হয়েছে।
এদিকে, নিহত আবু সাইদের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রাজিকুল ইসলাম ১১দিনেও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রদান করেননি।
এ ব্যাপারে রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যাক্ষ অধ্যাপক ডা. শাহ মো. সরওয়ার জাহানের সাথে তার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. রাজিকুল ইসলাম ছুটিতে আছেন সোমবার তিনি যোগদান করবেন। আশাকরা যায় দ্রুতই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
এদিকে, বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাইদকে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ এমন অভিযোগ করে বেরোবির বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বিশিষ্ট কলামিষ্ট ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। তার মরদেহ আমি দেখেছি সারা শরীরে অসংখ্য গুলি আর রাবার বুলেটের চিহ্ন।
সাইদ হত্যাকারী পুলিশ সদস্য ও তার নির্দ্দেশদাতা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যাবস্থা না নেয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, হত্যাকারী পুলিশ সদস্যদের বিচার না করলে তাদের গ্রেফতার করা না হলে পুলিশ বাহিনী ও সরকারের ভাবমুর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তবে আমরা চাই সাইদ হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন করে শাস্তি প্রদান করা হোক।
অপরদিকে, সাইদকে গুলি করার পর সে মাটিতে লুটিয়ে তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহবায়ক সাজু বাঁশফোর জানান, আমিসহ কয়েকজন মিলে সাইদকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, আমরা কয়েক বন্ধু যখন সাইদকে গুলিবিদ্ধ অবস্থার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম তখনও পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করছিলো। আমরা অভাবনীয় ভাবে বেঁচে যাই। তার পরেও আমরা সাইদকে প্রথমে একটি রিক্সায় পরে একটি অটো রিক্সায় করে হাসপাতালে নেবার সময় তার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু হাসপাতালে নেবার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করে।
প্রত্যাক্ষদর্শী আরেফিন তিতু জানান, তিনি খবর পান অনেক শিক্ষার্থী গুলি বিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। খবর পেয়ে তিনিও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানে নিহত সাইদকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পাই। তার শরীরে হাত দিয়ে দেখি শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। ভাবছিলাম হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষনা করে। নিহত সাইদের শরীরে অসংখ্য গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখেছি।
তিনি বলেন, তাকে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এর বিচার হওয়া উচিত।
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুখ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই। আমি মনে করি তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আওতায় আনতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে আবু সাইদ দাঁড়িয়ে আছেন তাকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি করছে সে কয়েকবার আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। পরে যখন সরাসরি ২০ ফুটের কম দূরত্ব থেকে গুলি করা হয় তখনই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ ঘটনাটি ঘটেছে বেরোবির প্রধান ফটকের সামনে।
এদিকে, কোটা বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাইদ নিহত ও সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনায় ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মতিউর রহমানকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের একটি তথ্য অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটির সদস্য করা হয়েছে রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. বিজন মোহন চাকী এবং সদস্য-সচিব করা হয়েছে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমানকে।
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক মতিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। তারপরও তদন্ত কাজ শুরু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভিডিও ও সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খুললেই সকল ষ্টক হোল্ডারদের সাথে কথা বলে দ্রুত প্রতিবেদন দেয়া হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার মোঃ মনিরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, পুলিশের কেউ গুলি করে থাকলে এবং তার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাইদ নিহত হবার পর তাজহাট থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। সেখানে ইট পাটকেলের আঘাতে তার মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ কমিশনার বললেন, সব ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে সিসি টিভি ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করা হচ্ছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনসহ সব কিছু পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান।
এদিকে, নিহত বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাইদের বাড়ি রংপুরের পীরগজ্ঞ উপজেলার মদনখালি ইউনিয়নের বাবন পাড়া গ্রাম থেকে তার বাবামা সহ স্বজনদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেশীরা জানান শুক্রবার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের বাসায় এসে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার জন্য যেতে বলেছেন। শনিবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে নিহত আবু সাইদের বাবা মকবুল হোসেন মা মনোয়ারা বেগম, ভাই আবু হোসেন , বোন সুমি আখতার , ভাবী সাবিনা আকতার গাড়িতে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রংপুর ত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।