ঢাকা ০৩:৩০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সামান্য কর্মচারী হলেও এমরানের আছে ক্ষমতার দাপট

চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:৪১:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪ ৭৫২ বার পড়া হয়েছে
বাংলা টাইমস অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

কমপক্ষে ছয় জন নেতা পাল্টিয়েছেন তিনি। পেশা হিসেবে কাগজে কলমে রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেড (সিইউএফএল) এর’ সামান্য এইচএসও পদধারী। কিন্তু পোষাকে আশাকে তাকে দেখে যে কেউ ভাববে তিনি সরকারী কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, না হয় বড় নেতা।

আড়ালে আবডালে তিনি আবার দাবিও করেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি। নাম তার মো. এমরান খান। ছোট খাটো মানুষ হলেও লম্বায় অনেক উচু। তার ক্ষমতার দাপট আকাশ সমান। যখন যে দিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা ধরার পুরোনো অভ্যাস তার। যুবক বয়সে করতেন ছাত্রদল। পরে আনোয়ারা-কর্ণফুলীর সাবেক সদস্য সদস্য সরোয়ার জামাল নিজাম এর সুপারিশে সিইউএফএলে চাকরির সুযোগ। তারপর তাকে ঠেকায় কে?

আয় রোজগার, পকেট ভারি করার প্রবণতা থেকে নিজেকে এখন পুরো উল্টিয়ে ফেলেছেন সিইউএফএলের এই সামান্য কর্মচারী। কেননা, লেজুড়বৃত্তি না করলে পদও পাওয়া যাবে না, আর্থিক কামাইও করা যাবে না। ফলে, মূল কাজ সরকারি চাকরি হলেও, নিজেকে বহু রঙে রাঙ্গিয়ে, বহু খোলস ছেড়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতাদের পিছু পিছু লেজুড়বৃত্তি করাই তার নেশা আর পেশা উঠেছে। এমন অভিযোগ স্বয়ং তার সহকর্মীদের। তবে এমরান এসব মানতে রাজি না।

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেড এর এইচএসও এমরান চাকরির পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়মিত অংশ নেন বিভিন্ন দলের নানা কর্মসূচিতে। তবে এখন আর বিএনপিতে নেই সে।

এমন কি তাঁকে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড এলাকার চিটাগং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডে বদলি করা হলেও ছাড়ছেন না আনোয়ারার সিইউএফএল। ছাড়ছেন না সিইউএফএল কলোনির বাসা। প্রকাশ্যে বীরদর্পে বহাল তবিয়তে বদলি কর্মস্থলেও অনুপস্থিত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অথচ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ অংশে বলা আছে, সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে নেতার লেজুড়বৃত্তিতে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।

জানা যায়, এইচএসও মো. এমরান খান বিএনপি সরকারের আমলে এমপি নিজামের সুপারিশে সিইউএফএলে চাকরি নিলেও এখন তা স্বীকার করেন না। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে দলের মধ্যে ও আনোয়ারায় ব্যাপক সমালোচনা চলছে। কারণ বর্তমানে সে পল্টি নিয়েছে। সময় দিচ্ছে আনোয়ারা উপজেলার নতুন চেয়ারম্যানের পিছনে।

এসব দৃশ্য দেখে আনোয়ারা উপজেলার রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, ‘সুবিধাবাদী মুখ গুলো এ রকমই। কিছুদিন আগেও এই এমরান খান ছিলেন প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ব্যক্তিগত সহকারি বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদের বেডরুমের লোক। বাবুর অর্বতমানে তিনি এখন বোরহানকে ক্জে লাগিয়ে শিল্পপতি আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির কাছাকাছি। এমনকি শিল্পপতির বাড়িতে অবাধ যাতায়াত তার।’

এর প্রভাব দেখিয়ে গত কয়েম মাস আগেও ছিলেন সিইউএফএল সিবিএ’র দাপুটে নেতা। কিন্তু ১২ মাস আগে সীতাকুণ্ডে বদলি হয়েও দখলে রাখেন সিইউএফএল কলোনির বাসা। সেই তিনি রাতারাতি পল্টি মেরে এখন আনোয়ারার নব নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মোজাম্মেল হকের ‘খাস লোক’ সাজার অপচেষ্টায় লিপ্ত এখন।

ছলে বলে কৌশলে মোজাম্মেলের কাছাকাছি থেকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের অনুষ্ঠানে নিয়মিত হাজিরা দেয়ার চেষ্টা করছেন। ইমরানের এমন পল্টিবাজি তৎপরতায় প্রশ্ন উঠেছে এবার কোন সুবিধা নিতে চান তিনি? নাকি গুপ্তচর হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের ভেতরের তথ্য প্রতিপক্ষের কাছে পাচারের মিশনে নেমেছেন! না অন্য কিছু মতলব। সে প্রশ্নের উত্তর এখনো অধরা।

স্থানীয়রা আরো জানান, ক্ষমতার জন্য যখন যাকে প্রয়োজন ইমরান তার দলে ভিড়তে দুই মিনিটও দেরি করেন না। সিইউএফএলের কাছের এলাকা গোবাদিয়ায় তার বেড়ে উঠা। সেখান থেকে নানা তদবিরে ভাগিয়ে নেন সিইউএফএলের ছোট চাকরি৷ এরপর হয়ে উঠার চেষ্টা করেন এক সময় কার ছাত্রনেতা ও বর্তমানে স্থানীয় বারশত ইউপি চেয়ারম্যান এম এ কাইয়ুম শাহ এর কাছের মানুষ।

কাইয়ুম শাহ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ইমরান সিবিএ নেতা হওয়ার ধান্ধায় নামেন। মূলত ইউপি চেয়ারম্যানের নাম পরিচয় ব্যবহার করে ঢুকে যান সিবিএ কমিটিতে। কয়েক বছর পর ইমরানের স্বাদ জাগে নিজের নামটি সিবিএ কমিটিতে উপরের দিকে নিয়ে যাওয়ার। ততদিন কাইয়ুম শাহ’র সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে।

এবার বোল পাল্টিয়ে নতুন ড্রয়িং রুম খুঁজতে থাকেন। ততদিনে তিনি বুঝে যান সিইউএফএল সার কারখানায় প্র‍য়াত আখতারুজ্জাম চৌধুরী বাবুর ২য় পুত্র আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি অনুসারীদের দাপটের বিষয়টি। এবার সংযোগ ঘটানোর জন্য দিন রাত হাজিরা দেওয়া শুরু করেন তার ব্যক্তিগত সহকারি বোরহান উদ্দিন মুরাদের বাড়িতে।

৪ বছরেরও বেশি সময় আটার মত লেগে থাকেন মুরাদের সাথে। ধরাকে সরা গরা জ্ঞান শুরু করতে থাকেন। কর্মচারী হয়েও নিয়মিত খারাপ আচরণ করতে থাকেন সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে। ইমরানের এমন ঔদ্ধত্যে অতিষ্ট হয়ে উঠে সবাই। সিউএফএলের উতপাদন বন্ধ, লোকসানি প্রতিষ্ঠানের সিবিএ নেতা হয়েও দুই হাতে টাকা কামাতে থাকেন।

তার অনিয়ম ও নানা কর্মকান্ডে বাধা দেওয়ায় ওক সময় সিইউএফএলের এমডিকে লাঞ্চিত করার ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ সময় অবিরুদ্ধ করে রাখা হয় এমডিকে। রাষ্টায়াত্ত সার কারখানায় এই ঘটনা সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়৷ সে ঘটনারও নায়ক তিনি। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উঠে আসে ইমরানের নেতৃত্বেই ঘটেছে সিইউএফএলের ইতিহাসে জঘন্যতম এই ঘটনা৷ শাস্তি হিসাবে সীতাকুন্ডে রাষ্ট্রায়াত্ত আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ইমরানকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়৷

অভিযোগ উঠেছে, সপ্তাহে ৫ দিন অফিস করার কথা থাকলেও ইমরান যান এক দিন। কখনো ওই একদিনও হাজিরা দেন না। বাকী সময় মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়ান বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে। অন্যত্র চাকরি করেও মূলত আনিসুজ্জামান রনি ও বোরহান উদ্দিন মুরাদের নাম ব্যবহার করে সিইউএফএল থেকে নিতে থাকেন সব সুযোগ সুবিধা।

সুযোগ সুবিধা পেলেও ইমরান আশায় ছিলেন দ্রুতই তাকে বদলি করে নিয়ে আসা হবে সিইউএফএলে। সেই আশা পূরণ বিলম্বিত হওয়ায় ইমরান খুঁজতে থাকেন ভিন্নপথ। দেশের প্রথম সারির দৈনিকের আনোয়ারা উপজেলার একটি প্রতিনিধি ও সাবেক শিবির কর্মীর এক ইউটিউভার নিয়ে আনোয়ারা উপজেলায় নতুন তদবির সিন্ডিকেট তৈরি করেন।অফিসে গর হাজির থেকে তদবির ব্যবসা আর তথ্য পাচারের ধান্ধায়। যে সিন্ডিকেটে হাত মিলিয়েছে, সারকারখানার জালাল, নুরুল আমিন, সোলায়মান, আনোয়ারুল, আবদুল কাদের, ওসমানিসহ অনেকেই।

প্রশাসনে কেউ বদলি হয়ে আসলে ওই বিতর্কিত রিপোর্টারের মাধ্যমে তদবির করেন। ড্র‍য়িং রুম, বেড রুমের লোক সাজতে ইমরানের ব্যতি ব্যস্ততা বেড়ে যায়। অভিযোগ আছে, আনোয়ারা উপজেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তার বেড রুমের লোক হয়ে উঠেছিলেন ইমরান ও তার ইউটিউবার সিন্ডিকেট। তাঁর বদলির পর নতুন কর্মকর্তার পেছনেও একই ভাবে অনূসরণ করতে শুরু করেন।

গত ২৯ মে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাচনের কয়েকদিন আগে আবার বদলে যেতে থাকে পল্টিবাজ ইমরানের মুখোশ৷ দীর্ঘ দিনের আনিসুজ্জামান রনি ও বোরহানুদ্দিন মুরাদের আশ্রয়ে থাকা ইমরান অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান সমর্থিত প্রার্থী কাজী মোজাম্মেলের পক্ষে ভিড়তে থাকেন। সিইউএফএলে বদলি হয়ে আসা ও সিবিএ রাজনীতির ধান্ধায় সার্বক্ষণিক ঘুর ঘুর করতে থাকেন কাজী মোজাম্মেলের অফিসে।

ছলে বলে কৌশলে হাত করার চেষ্টা করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রীর অনুসারী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অহিদুল ইসলাম অহিদ কে। ফেসবুকে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে স্ট্যাটাসও দেন। কিন্ত সুবিধার জন্য সব সময় পল্টিবাজিতে থাকা ইমরানের চেহারা এবার সবার কাছে পরিষ্কার।

সিইউএফএল সিবিএ সংশ্লিষ্টরা জানান, সিবিএ নেতা ইমরান খান সবার জন্য বিপদজনক। তিনি এই পক্ষের কথা ওই পক্ষে পাচার করে নিজে আখের গুছাতে ব্যস্ত থাকেন। নিজের স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে পল্টি মারেন। যার মাধ্যমে তার উত্থান তাকে বিপদেও ফেলতেও তিনি দুই মিনিট চিন্তা করেন না৷ এখন আখের গুছাতে উপজেলা চেয়ারম্যানের পক্ষে ভিড়েছেন। ভোটের এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত ছিলেন প্রতিপক্ষের মানুষ৷ সন্দেহ রয়েছে তিনি প্রতিপক্ষের গুপ্তচর হিসেবে মুখোশ পালটিয়ে ভিড়েছেন কিনা।

এ সব বিষয়ে জানতে ইমরান খানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এসব বানোয়াট ও মিথ্যা অভিযোগ। আমি একজন চাকরিজীবী। তবে রাজনীতি যারা করে এ রকম অনেক বন্ধু বা শুভকাংখী আমার থাকতে পারে। সেটা অসুবিধার কিছু না।’

চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘উনাকে বদলি করা হয়েছে বহু আগেই। বাসা আছে কিনা খবর নিয়ে ব্যবস্থা নিবো।’

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ সরকারি চাকরি করে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে সুযোগ সুবিধা নেবে। তা তো অসম্ভব। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব।’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

সামান্য কর্মচারী হলেও এমরানের আছে ক্ষমতার দাপট

সংবাদ প্রকাশের সময় : ০১:৪১:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪

কমপক্ষে ছয় জন নেতা পাল্টিয়েছেন তিনি। পেশা হিসেবে কাগজে কলমে রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেড (সিইউএফএল) এর’ সামান্য এইচএসও পদধারী। কিন্তু পোষাকে আশাকে তাকে দেখে যে কেউ ভাববে তিনি সরকারী কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, না হয় বড় নেতা।

আড়ালে আবডালে তিনি আবার দাবিও করেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি। নাম তার মো. এমরান খান। ছোট খাটো মানুষ হলেও লম্বায় অনেক উচু। তার ক্ষমতার দাপট আকাশ সমান। যখন যে দিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা ধরার পুরোনো অভ্যাস তার। যুবক বয়সে করতেন ছাত্রদল। পরে আনোয়ারা-কর্ণফুলীর সাবেক সদস্য সদস্য সরোয়ার জামাল নিজাম এর সুপারিশে সিইউএফএলে চাকরির সুযোগ। তারপর তাকে ঠেকায় কে?

আয় রোজগার, পকেট ভারি করার প্রবণতা থেকে নিজেকে এখন পুরো উল্টিয়ে ফেলেছেন সিইউএফএলের এই সামান্য কর্মচারী। কেননা, লেজুড়বৃত্তি না করলে পদও পাওয়া যাবে না, আর্থিক কামাইও করা যাবে না। ফলে, মূল কাজ সরকারি চাকরি হলেও, নিজেকে বহু রঙে রাঙ্গিয়ে, বহু খোলস ছেড়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতাদের পিছু পিছু লেজুড়বৃত্তি করাই তার নেশা আর পেশা উঠেছে। এমন অভিযোগ স্বয়ং তার সহকর্মীদের। তবে এমরান এসব মানতে রাজি না।

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেড এর এইচএসও এমরান চাকরির পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়মিত অংশ নেন বিভিন্ন দলের নানা কর্মসূচিতে। তবে এখন আর বিএনপিতে নেই সে।

এমন কি তাঁকে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড এলাকার চিটাগং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডে বদলি করা হলেও ছাড়ছেন না আনোয়ারার সিইউএফএল। ছাড়ছেন না সিইউএফএল কলোনির বাসা। প্রকাশ্যে বীরদর্পে বহাল তবিয়তে বদলি কর্মস্থলেও অনুপস্থিত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অথচ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ অংশে বলা আছে, সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে নেতার লেজুড়বৃত্তিতে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।

জানা যায়, এইচএসও মো. এমরান খান বিএনপি সরকারের আমলে এমপি নিজামের সুপারিশে সিইউএফএলে চাকরি নিলেও এখন তা স্বীকার করেন না। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে দলের মধ্যে ও আনোয়ারায় ব্যাপক সমালোচনা চলছে। কারণ বর্তমানে সে পল্টি নিয়েছে। সময় দিচ্ছে আনোয়ারা উপজেলার নতুন চেয়ারম্যানের পিছনে।

এসব দৃশ্য দেখে আনোয়ারা উপজেলার রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, ‘সুবিধাবাদী মুখ গুলো এ রকমই। কিছুদিন আগেও এই এমরান খান ছিলেন প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ব্যক্তিগত সহকারি বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদের বেডরুমের লোক। বাবুর অর্বতমানে তিনি এখন বোরহানকে ক্জে লাগিয়ে শিল্পপতি আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির কাছাকাছি। এমনকি শিল্পপতির বাড়িতে অবাধ যাতায়াত তার।’

এর প্রভাব দেখিয়ে গত কয়েম মাস আগেও ছিলেন সিইউএফএল সিবিএ’র দাপুটে নেতা। কিন্তু ১২ মাস আগে সীতাকুণ্ডে বদলি হয়েও দখলে রাখেন সিইউএফএল কলোনির বাসা। সেই তিনি রাতারাতি পল্টি মেরে এখন আনোয়ারার নব নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মোজাম্মেল হকের ‘খাস লোক’ সাজার অপচেষ্টায় লিপ্ত এখন।

ছলে বলে কৌশলে মোজাম্মেলের কাছাকাছি থেকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের অনুষ্ঠানে নিয়মিত হাজিরা দেয়ার চেষ্টা করছেন। ইমরানের এমন পল্টিবাজি তৎপরতায় প্রশ্ন উঠেছে এবার কোন সুবিধা নিতে চান তিনি? নাকি গুপ্তচর হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের ভেতরের তথ্য প্রতিপক্ষের কাছে পাচারের মিশনে নেমেছেন! না অন্য কিছু মতলব। সে প্রশ্নের উত্তর এখনো অধরা।

স্থানীয়রা আরো জানান, ক্ষমতার জন্য যখন যাকে প্রয়োজন ইমরান তার দলে ভিড়তে দুই মিনিটও দেরি করেন না। সিইউএফএলের কাছের এলাকা গোবাদিয়ায় তার বেড়ে উঠা। সেখান থেকে নানা তদবিরে ভাগিয়ে নেন সিইউএফএলের ছোট চাকরি৷ এরপর হয়ে উঠার চেষ্টা করেন এক সময় কার ছাত্রনেতা ও বর্তমানে স্থানীয় বারশত ইউপি চেয়ারম্যান এম এ কাইয়ুম শাহ এর কাছের মানুষ।

কাইয়ুম শাহ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ইমরান সিবিএ নেতা হওয়ার ধান্ধায় নামেন। মূলত ইউপি চেয়ারম্যানের নাম পরিচয় ব্যবহার করে ঢুকে যান সিবিএ কমিটিতে। কয়েক বছর পর ইমরানের স্বাদ জাগে নিজের নামটি সিবিএ কমিটিতে উপরের দিকে নিয়ে যাওয়ার। ততদিন কাইয়ুম শাহ’র সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে।

এবার বোল পাল্টিয়ে নতুন ড্রয়িং রুম খুঁজতে থাকেন। ততদিনে তিনি বুঝে যান সিইউএফএল সার কারখানায় প্র‍য়াত আখতারুজ্জাম চৌধুরী বাবুর ২য় পুত্র আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি অনুসারীদের দাপটের বিষয়টি। এবার সংযোগ ঘটানোর জন্য দিন রাত হাজিরা দেওয়া শুরু করেন তার ব্যক্তিগত সহকারি বোরহান উদ্দিন মুরাদের বাড়িতে।

৪ বছরেরও বেশি সময় আটার মত লেগে থাকেন মুরাদের সাথে। ধরাকে সরা গরা জ্ঞান শুরু করতে থাকেন। কর্মচারী হয়েও নিয়মিত খারাপ আচরণ করতে থাকেন সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে। ইমরানের এমন ঔদ্ধত্যে অতিষ্ট হয়ে উঠে সবাই। সিউএফএলের উতপাদন বন্ধ, লোকসানি প্রতিষ্ঠানের সিবিএ নেতা হয়েও দুই হাতে টাকা কামাতে থাকেন।

তার অনিয়ম ও নানা কর্মকান্ডে বাধা দেওয়ায় ওক সময় সিইউএফএলের এমডিকে লাঞ্চিত করার ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ সময় অবিরুদ্ধ করে রাখা হয় এমডিকে। রাষ্টায়াত্ত সার কারখানায় এই ঘটনা সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়৷ সে ঘটনারও নায়ক তিনি। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উঠে আসে ইমরানের নেতৃত্বেই ঘটেছে সিইউএফএলের ইতিহাসে জঘন্যতম এই ঘটনা৷ শাস্তি হিসাবে সীতাকুন্ডে রাষ্ট্রায়াত্ত আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ইমরানকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়৷

অভিযোগ উঠেছে, সপ্তাহে ৫ দিন অফিস করার কথা থাকলেও ইমরান যান এক দিন। কখনো ওই একদিনও হাজিরা দেন না। বাকী সময় মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়ান বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে। অন্যত্র চাকরি করেও মূলত আনিসুজ্জামান রনি ও বোরহান উদ্দিন মুরাদের নাম ব্যবহার করে সিইউএফএল থেকে নিতে থাকেন সব সুযোগ সুবিধা।

সুযোগ সুবিধা পেলেও ইমরান আশায় ছিলেন দ্রুতই তাকে বদলি করে নিয়ে আসা হবে সিইউএফএলে। সেই আশা পূরণ বিলম্বিত হওয়ায় ইমরান খুঁজতে থাকেন ভিন্নপথ। দেশের প্রথম সারির দৈনিকের আনোয়ারা উপজেলার একটি প্রতিনিধি ও সাবেক শিবির কর্মীর এক ইউটিউভার নিয়ে আনোয়ারা উপজেলায় নতুন তদবির সিন্ডিকেট তৈরি করেন।অফিসে গর হাজির থেকে তদবির ব্যবসা আর তথ্য পাচারের ধান্ধায়। যে সিন্ডিকেটে হাত মিলিয়েছে, সারকারখানার জালাল, নুরুল আমিন, সোলায়মান, আনোয়ারুল, আবদুল কাদের, ওসমানিসহ অনেকেই।

প্রশাসনে কেউ বদলি হয়ে আসলে ওই বিতর্কিত রিপোর্টারের মাধ্যমে তদবির করেন। ড্র‍য়িং রুম, বেড রুমের লোক সাজতে ইমরানের ব্যতি ব্যস্ততা বেড়ে যায়। অভিযোগ আছে, আনোয়ারা উপজেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তার বেড রুমের লোক হয়ে উঠেছিলেন ইমরান ও তার ইউটিউবার সিন্ডিকেট। তাঁর বদলির পর নতুন কর্মকর্তার পেছনেও একই ভাবে অনূসরণ করতে শুরু করেন।

গত ২৯ মে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাচনের কয়েকদিন আগে আবার বদলে যেতে থাকে পল্টিবাজ ইমরানের মুখোশ৷ দীর্ঘ দিনের আনিসুজ্জামান রনি ও বোরহানুদ্দিন মুরাদের আশ্রয়ে থাকা ইমরান অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান সমর্থিত প্রার্থী কাজী মোজাম্মেলের পক্ষে ভিড়তে থাকেন। সিইউএফএলে বদলি হয়ে আসা ও সিবিএ রাজনীতির ধান্ধায় সার্বক্ষণিক ঘুর ঘুর করতে থাকেন কাজী মোজাম্মেলের অফিসে।

ছলে বলে কৌশলে হাত করার চেষ্টা করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রীর অনুসারী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অহিদুল ইসলাম অহিদ কে। ফেসবুকে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে স্ট্যাটাসও দেন। কিন্ত সুবিধার জন্য সব সময় পল্টিবাজিতে থাকা ইমরানের চেহারা এবার সবার কাছে পরিষ্কার।

সিইউএফএল সিবিএ সংশ্লিষ্টরা জানান, সিবিএ নেতা ইমরান খান সবার জন্য বিপদজনক। তিনি এই পক্ষের কথা ওই পক্ষে পাচার করে নিজে আখের গুছাতে ব্যস্ত থাকেন। নিজের স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে পল্টি মারেন। যার মাধ্যমে তার উত্থান তাকে বিপদেও ফেলতেও তিনি দুই মিনিট চিন্তা করেন না৷ এখন আখের গুছাতে উপজেলা চেয়ারম্যানের পক্ষে ভিড়েছেন। ভোটের এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত ছিলেন প্রতিপক্ষের মানুষ৷ সন্দেহ রয়েছে তিনি প্রতিপক্ষের গুপ্তচর হিসেবে মুখোশ পালটিয়ে ভিড়েছেন কিনা।

এ সব বিষয়ে জানতে ইমরান খানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এসব বানোয়াট ও মিথ্যা অভিযোগ। আমি একজন চাকরিজীবী। তবে রাজনীতি যারা করে এ রকম অনেক বন্ধু বা শুভকাংখী আমার থাকতে পারে। সেটা অসুবিধার কিছু না।’

চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘উনাকে বদলি করা হয়েছে বহু আগেই। বাসা আছে কিনা খবর নিয়ে ব্যবস্থা নিবো।’

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ সরকারি চাকরি করে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে সুযোগ সুবিধা নেবে। তা তো অসম্ভব। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব।’