সীমান্ত হত্যার শেষ কোথায়? এখনো অপেক্ষায় ফেলানীর মা-বাবা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:৪৭:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৫ ৫৮ বার পড়া হয়েছে
সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা-নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন সীমান্তবর্তী বাসীন্দারা। হত্যা ও নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েও কার্যত কোন সুফল মিলছে না। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিধান না থাকলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বারবার ব্যবহার করছে আগ্নেয়াস্ত্র। শুধুমাত্র বাংলাদেশীরা সীমান্ত অতিক্রমকালে হত্যার শিকার হচ্ছে না, অনেক সময় বিএসএফ সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেও বাংলাদেশিদের হত্যা এবং গবাধিপশুসহ কৃষি পণ্য লুটে নিয়ে যায়।
বিগত সাড়ে ১৬ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ৫৮৮ জনকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সোমবার (৬ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার।
সীমান্তে সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকান্ড ফেলানী হত্যা। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর উত্তর অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নির্মমভাবে তার মৃত্যু হয়। সেদিন বাবার সঙ্গে ৯৪৭ নং আন্তর্জাতিক ৩নং সাব পিলারের পাশ দিয়ে মই বেয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে দেশে ফেরার সময় টহলরত ভারতের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ তাকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় আজও বিচার পায়নি তার পরিবার।
ফেলানী হত্যার বিচারের অপেক্ষায় দিন তার মা-বাবা। বাবা নূরুল ইসলাম ও মা জাহানারা বলেন, সেদিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা ভুলতে পারিনি আজও। তার আত্মচিৎকারে গভীর রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় আমাদের। দু’চোখে অশ্রু ঝরে। মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মানবাধিকার সংস্থাসহ বহুজনের কাছে গিয়েছি কিন্তু বিচার পেলাম না।
২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট কোচবিহার জেলার বিএসএফের ১৮১ সদর দপ্তরে স্থাপিত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যার বিচারকাজ শুরু হয়। ৫ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। রায় প্রত্যাখ্যান করে ১১ সেপ্টেম্বর ফেলানীর বাবা ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে সে দেশের সরকারকে ন্যায়বিচারের আশায় পত্র দেন। আবারও ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার কার্যক্রম শুরু হলেও বিভিন্ন কারণে তা একাধিকবার স্থগিত হয়।
এরপর ২০১৫ সালে আইন ও শালিস কেন্দ্র এবং ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ আরও একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে। ৩১ আগস্ট ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সেদেশের সরকারকে ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ লাখ রুপী প্রদানের অনুরোধ করেন। এর জবাবে সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলামকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়। এরপরে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে কয়েক দফা শুনানি পিছিয়ে যায়। পরে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ শুনানির দিন ধার্য হলেও তা আজও হয়নি।
ফেলানী হত্যা মামলার বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বলেন, আমরা এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পাইনি। পেলে মানবাধিকার সুরক্ষার পথ সুগম হত। এছাড়াও ২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ফেলানী হত্যা ঘটনায় স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম প্রথম ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী দ্বিতীয় বাদী হয়ে আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া) সচিব এবং বিএসএফের মহাপরিচালককে বিবাদী করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নয়াদিল্লীতে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী একটি ফৌজদারি মামলা করেন। তারা ২০১৫ সালের ২১ জুলাই ফেলানীর বাবার জন্য অন্তর্র্বতীকালীন ক্ষতিপূরণ চেয়ে আরও একটি আবেদন করেন।
অধিকারের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বিএসএফ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৮৮ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। এই সময়ে আহত হয়েছে আরো ৭৭৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক। সীমান্তে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০০৯ সালে। ওই বছর বিএসএফের হাতে মোট হতাহতের শিকার হন ১৭৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে ৯৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আর ৭৭ জন আহত হয়েছে।
এ ছাড়া ২০১০ সালে ৭৪ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ৩৮ জন, ২০১৩ সালে ২৯ জন, ২০১৪ সালে ৩৫ জন, ২০১৫ সালে ৪৪ জন, ২০১৬ সালে ২৯ জন, ২০১৭ সালে ২৫ জন, ২০১৮ সালে ১১ জন, ২০১৯ সালে ৪১ জন, ২০২০ সালে ৫১ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২২ সালে ১৮ জন, ২০২৩ সালে ২৮ জন ও ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৯ জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২০৮ জন চোরাচালানী, অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ৪২৬ জন বাংলাদেশী নাগরিক ও ১৮ জন ভারতীয় নাগরিককে আটক করেছে। পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এসময় উদ্ধার করা হয়েছে, ১টি পিস্তল, ১টি রাইফেল, ১টি এয়ার গান, ৫টি ম্যাগাজিন, ১৪ রাউন্ড গুলি, ১টি মর্টার শেল, ১টি গ্রেনেড ও ১টি রকেটের গোলা। এছাড়া ১৪৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকার চোরাচালান পণ্যসামগ্রী আটক করা হয়। গতকাল সোমবার বিজিবির বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
তাতে বলা হয়, সীমান্তে বিজিবির অভিযানে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ৪২৬ জন বাংলাদেশী নাগরিক ও ১৮ জন ভারতীয় নাগরিককে আটকের পর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে ৭৭২ জন মিয়ানমার নাগরিককে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদক পাচার ও অন্যান্য চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০৮ জন চোরাচালানীকেও আটক করা হয়। বিজিবি শুধু অনুপ্রবেশকারীদেরকেই আটক করেনি। আটক করা হয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র।
আটক করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- ১টি পিস্তল, ১টি রাইফেল, ১টি এয়ার গান, ৫টি ম্যাগাজিন, ১৪ রাউন্ড গুলি, ১টি মর্টার শেল, ১টি গ্রেনেড ও ১টি রকেট গোলা। বিজিবি আরও জানায়, ডিসেম্বরে দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে সর্বমোট ১৪৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান পণ্যসামগ্রী আটক করতে সক্ষম হয়।
এসবের মধ্যে রয়েছে- ৪ কেজি ১৯২ গ্রাম স্বর্ণ, ১০ কেজি ১২৫ গ্রাম রুপা, ১১ হাজার ৫২৩টি শাড়ী, ৯ হাজার ৬১৭টি থ্রিপিস/শার্টপিস/চাদর/কম্বল, ৮ হাজার ৩৮৭টি তৈরী পোশাক, ১০ হাজার ২০৪ মিটার থান কাপড়, ৭ লাখ ৮৯ হাজার ১৫২টি কসমেটিক্স সামগ্রী, ৪ হাজার ৭০২টি ইমিটেশন গহনা, ১৩ লাখ ৪২ হাজার ৬০৩টি আতশবাজি, ৬ হাজার ৭৮১ ঘনফুট কাঠ, ৬ হাজার ৩৬ কেজি চা পাতা, ২১ হাজার ৪৯০ কেজি সুপারি, ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩৯৫ কেজি চিনি, ১২ হাজার ৬২৫ কেজি সার, ১ হাজার ৭৭৪ প্যাকেট বিভিন্ন প্রকার বীজ, ৮০ হাজার ৯৪০ কেজি কয়লা, ৫২০ ঘনফুট পাথর, ১৯ লাখ ৩৬ হাজার ২০০ ঘনফুট বালু, ৫৮৩টি মোবাইল, ৩০ হাজার ৬৭০টি চশমা, ৪৬ হাজার ৯৬৬ কেজি বিভিন্ন প্রকার ফল, ১ লাখ ৩১ হাজার ৪৬৩ কেজি রসুন, ১১ হাজার ৭৮৮ কেজি জিরা, ১টি কষ্টি পাথরের মূর্তি, ৫৬০ গ্রাম সাপের বিষ, ৫টি ট্রাক, ১টি বাস, ৬টি পিকআপ, ৩টি প্রাইভেটকার/মাইক্রোবাস, ৩টি ট্রলি, ৭৪টি নৌকা, ৩১টি সিএনজি/ইজিবাইক, ৭২টি মোটরসাইকেল, ২২টি ভ্যান গাড়ি ও ৩০টি বাইসাইকেল।
এছাড়াও আটক করা মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে- ২ লাখ ৬৬ হাজার ২৬২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ১ কেজি ৭৯০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস, ৬ কেজি ২৬৭ গ্রাম হেরোইন, ৫ কেজি ৭৮৮ গ্রাম কোকেন, ২৮ হাজার ৯১৩ বোতল ফেনসিডিল, ১২ বোতল এলএসডি, ১৮ হাজার ৩২৪ বোতল বিদেশী মদ, ৫৯২ লিটার বাংলা মদ, ৯২১ ক্যান বিয়ার, ১ হাজার ৯৩ কেজি গাঁজা, ১ লাখ ২ হাজার ৮০০ প্যাকেট বিড়ি ও সিগারেট, ৪১ হাজার ২৯৯টি নেশাজাতীয় ট্যাবলেট/ইনজেকশন, ৩ হাজার ৫২৪ বোতল ইস্কাফ সিরাপ, ১ হাজার ২৩০ বোতল এমকেডিল/কফিডিল, ৩৭ লাখ ১১ হাজার ৫৪৭ পিস বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও ৭৭ হাজার ৮৯২টি এ্যানেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট।