ভারতে চাকরির প্রলোভন কৌশলে পাচার
যাচ্ছে নারী, আসছে গরু
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১০:১০:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৫ ৪৪ বার পড়া হয়েছে
চটকদার চাকরির বিজ্ঞাপন ও বেশি বেতনের প্রলোভন দিয়ে ভারতে নারী পাচার করছে একটি চক্র। পাচার হওয়ার পর শুরু হয় দুর্বিসহ জীবন। মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠী লক্ষ্য করেই পাচারের ফাঁদ পাতে চক্রটি। নারী পাচার বাংলাদেশে ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ছে। এতে যোগসাজশ রয়েছে দেশ-বিদেশের চক্র।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, দেশি-বিদেশি নারীপাচার চক্রগুলো বেশ শক্তিশালী। তাই সবাই সচেতন না হলে এমন জঘন্য কারবার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
সূত্রমতে, প্রথমে কম বয়সী মেয়েদের বিদেশে লোভনীয় বেতনে চাকরির অফার দেয়া হয়। এরপর বিদেশ যেতে নেয়া হতো না কোনো টাকা, উল্টো অগ্রিম টাকা দেয়া হতো। চক্রটির ফাঁদে পা দিলে নারীদের আনা হতো ঢাকায়। রাখা হতো দামি হোটেলে। তারপর তৈরি করা হতো পাসপোর্ট, বিএমইটি কার্ড ও বিদেশ যাওয়ার করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বেসরকারী গণমাধ্যমে উঠে আসে পাচারের নতুন চাঞ্চল্যকর তথ্য। পাচার করার নতুন কৌশল হিসাবে উঠে এসেছে গবাদিপশু গরুর নাম। তথ্যমতে, অনেক পাচারকারীরা নারীকে ভারতে পাচারে করে বিনিময়ে সেখান থেকে গরু নিয়ে আসে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর মগবাজার এলাকার দুই বান্ধবী মরিয়ম (ছদ্মনাম) ও মুক্তার (ছদ্মনাম) ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। পাচারকারীরা মূলত এসব তরুণীর আর্থিক দুর্বলতার বিষয়টিকে কাজে লাগাচ্ছে।
জানা গেছে, এই মানবপাচার চক্রের সদস্য আল আমিন হোসেনের বাড়ি যশোরের শার্শায়। স্বল্প শিক্ষিত এই ব্যক্তি জমিজমা সব বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে পাচারে সক্রিয় হন। পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলে তিনি আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। ভারতে তার নিয়মিত যাতায়াত আছে।
তিনি বলেন, ভারতে আমি মেয়ে নিয়ে যেতাম এবং গরু নিয়ে ফিরতাম। আমার সঙ্গে মূলত শফিকুল, আক্তারুল, অলি, জয়ন্ত, শহীদ কাজ করে এবং তারা সবাই আমার গ্রামের। নদী চাকরি দেওয়ার কথা বলে ঢাকা থেকে মেয়েদের এনে ভারতে পাচার করতেন।
আল আমিনের দেয়া তথ্যমতে, নদীর সঙ্গে ইসরাফিল হোসেন, খোকন, বিনাশ ও মামুন পাচারের সঙ্গে জড়িত। সীমান্তের ওপারে সবুজ, সাগর, বিউটি ও হৃদয় বাবুর যোগাযোগ ছিল। খোকনের মাধ্যমে তিনি এসব নাম জেনেছেন। তারা মেয়েদের ভারতে নিয়ে বিভিন্ন হোটেলে রেখে খারাপ কাজ করাত বলে তিনি শুনেছেন। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়েদের বর্ডারে নিয়ে এলে আমিরুল, আব্দুল হাই ও সিরাজুল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। তরিকুলের ইজি বাইকে করে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিত। মেয়েদের আমার বাড়িতে রাখতাম। বিনিময়ে জনপ্রতি ২০০ টাকা পেতাম। খোকন নিজে কিংবা সাইফুলের মাধ্যমে বিকাশ করত।
পুলিশ এলাকায় ঢুকলে নেছার উদ্দিন ও সাইফুল সতর্ক করে দিত। আমরা একটা মেয়ে ভারতে পাচার করতে পারলে জনপ্রতি এক হাজার টাকা পেতাম এবং নেছার উদ্দিনকে জনপ্রতি এক হাজার টাকা দিতে হতো। আমি প্রায় ৫০-৬০ জন মেয়েকে বর্ডার দিয়ে পার করেছি।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় মা-বাবা ও চার বোনের সঙ্গে থাকতেন বৃষ্টি (ছদ্মনাম)। টানাটানির সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় চাকরি খুঁজছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে ফেসবুকে নদী আক্তারের সঙ্গে পরিচয়। নদী তাাকে পার্লারে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে ভারতে পাচার করেন। বৃষ্টিকে সেখানে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করা হয়। বৃষ্টিকে ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করা হয়। পাঁচ মাস পর তিনি বেঙ্গালুরুর বন্দিদশা থেকে পালান। ২০২১ সালের মে মাসে বৃষ্টি কলকাতা হয়ে সীমান্ত পথে দেশে ফেরেন।
এ ঘটনায় একই বছর ১৯ জুন পাচার করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও আইনে মামলা হয়। বৃষ্টির এই ঘটনা শুধু একজন-দুজনের নয়। সংঘবদ্ধ পাচারচক্র এমন আরো অনেক তরুণীকে চাকরি দেওয়াসহ নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ভারতে পাচার করে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীকে ভারতে পাচারে করে বিনিময়ে সেখান থেকে গরু নিয়ে আসা হয়। ভারতে মানবপাচারের ঘটনায় ২০২১ সালে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় করা পৃথক চারটি মামলার তদন্ত শেষে সম্প্রতি ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। এতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, সিটিটিসির পরিদর্শক মো. সেলিম আকতার ও উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আব্দুর রউফ তালুকদারের দেওয়া অভিযোগপত্রে আসামি রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় ও আসামি নদী আক্তার ওরফে ইতি ওরফে নূরজাহানসহ ৫১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আরো ৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এ জন্য তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করা হয়। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে আসামি রুবেল সরকার রাহুল ও আশরাফুল ইসলাম রাফি এখন কারাগারে। ২৮ আসামি পলাতক ও অপর আসামিরা জামিনে রয়েছেন। ভারতে মানবপাচারে জড়িত অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন মো. ইসরাফিল হোসেন খোকন, মো. তরিকুল ইসলাম, মো. আল আমিন হোসেন, আব্দুল হাই ওরফে সবুজ, সাইফুল ইসলাম, বিনাস সিকদার, মো. আমিরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম রাফিসহ অন্যরা।
অভিযুক্তদের একজন মো. তরিকুল ইসলামের বাড়ি বেনাপোল। পেশায় ইজি বাইকচালক। তার ইজি বাইকে নদী নামের এক নারী যাতায়াত করতেন। পরে তিনি জানতে পারেন, নদী নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য। ভারতে যাতায়াত আছে। নদীর মাধ্যমে তরিকুলও নারী পাচারে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পর তরিকুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে তরিকুল বলেন, নদী, ইসরাফিল হোসেন, খোকন, মামুন ও বিনাশ মিলে ভারতে মেয়ে পাচার করতেন। তাঁরা ঢাকা কিংবা অন্য কোনো স্থান থেকে মেয়েদের চাকরি দেওয়ার কথা বলে ধোঁকা দিয়ে নিয়ে আসতেন। পরে খোকনের মাধ্যমে আমি মেয়েদের বুঝে নিয়ে আল আমিন নামের একজনের বাড়িতে পৌঁছে দিতাম। আমাকে প্রতিটি মেয়ের জন্য ৫০০ টাকা করে দেওয়া হতো। আমি শুধু এই কাজটুকু করতাম। এ পর্যন্ত ২০-২৫ জন মেয়েকে আল আমিনের বাড়ি দিয়ে এসেছি।
জানা গেছে, ভারত সীমান্ত পথ দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদশে গরু ঢুকছে। চোরাচালানিদের সঙ্গে গরু ব্যাপারিদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার করার পর ব্যাপারি ও দালালদের মাধ্যমে গরু একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলে যাচ্ছে। আনা হচ্ছে কিছুৃ মহিষও। এতে দেশের খামারিরা লোকসানের মুখে পড়তে পারেন।
অবশ্য সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবি ও কোষ্টগার্ড ভারত এবং মিয়ানমার থেকে গরু ঢোকার বিষয়টি অভিযোগ অস্বীকার করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ একাধিক উপজেলায় বিপুলসংখ্যক মিয়ানমারের পশু ঢুকেছে। এসব পশুর অধিকাংশ রাখা হচ্ছে রামুর গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন এবং চকরিয়ার বিভিন্ন স্থানে। এসব পশু বেচাকেনা চলছে প্রকাশ্যে। প্রতিটি গরু ও মহিষ মিয়ানমার থেকে ৬০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায় কিনে তা বিক্রি করা হচ্ছে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়।
সিলেটের সীমান্ত দিয়েও প্রতিদিন আসছে ভারত থেকে গরু। কোম্পানীগঞ্জ সীমানার ১২৬০ নম্বর পিলারসংলগ্ন হয়ে দমদমা নালা দিয়ে গরু ঢুকছে। পরে সেগুলো গোয়াইনঘাট এলাকার ভিতরগুল ও বিছনাকান্দি হয়ে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে যায়। ভারতের খাসিয়া নাগরিকরা দিনে গরুগুলো নির্জন স্থানে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে এনে রাখে। রাতের আঁধারে সেগুলো কাঁটাতারের নিচ দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকানো হয়। এছাড়া সিলেটের জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট সীমান্ত দিয়েও পশু ঢুকছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম ফটিকছড়ির সবচেয়ে বড় পশুর হাট বসে ভারত সীমান্তবর্তী ফেনী নদীর পাশে বাগানবাজারে। একদিকে ভারত, অন্যদিকে খাগড়াছড়ির রামগড়ের মাঝে এ পশুর হাট। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও পাটগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন শত শত ভারতীয় গরু চোরাপথে বাংলাদেশে ঢুকছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, যারা দেশের বাইরে থাকে, তারা স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে মানবপাচার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। অনেকে জামিন পেয়ে ফের এ ধরনের কাজে জড়িয়ে পড়ে। তাই ভারতে পাচারের ঘটনায় করা মামলাগুলোর তাড়াতাড়ি বিচার করা উচিত।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সালমা আলী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের সঠিক প্রয়োগ ও নজরদারি নেই। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সংঘবদ্ধ চক্র নারীদের ভারতে পাচার করে। এদের সঙ্গে সরকারের লোকজনও জড়িত।
ডিএমপির (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা মামলার মেরিট অনুযায়ী তদন্তকাজ করি। মানবপাচারে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, আইনগত দিক বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়।