তানোরে একদিকে ধান মাড়াই অপরদিকে আলু রোপনে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণীরা
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৮:০৪:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ৩৭ বার পড়া হয়েছে
কৃষিভান্ডার হিসেবে খ্যাত রাজশাহীর তানোর উপজেলা। এ উপজেলার কৃষকরা একদিকে রোপাআমন ধান মাড়াই আর অপরদিকে আলু রোপনে মহা ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। দিন-রাত সমান তালে চলছে কৃষি কাজ। এছাড়াও বিলকুমারী বিলে বোরো বীজতলা তৈরি এবং বপনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সমান তালে। রোপা আমন ধান কাটা ইতিপূর্বেই শেষের মধ্যে। গারস্থ্য কৃষকদের খৈলানে বা বাড়ির আঙ্গিনায় বিশাল বিশাল ধানের গাদা বা পালা শোভা পাচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে আলু রোপনের কাজ। আর রাতে ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে জোরালো ভাবে। এক কথায় ত্রিমুখী কৃষি কাজে সময় পার হচ্ছে। খাওয়া, দাওয়া ও গোসলের কোন সময় নেই কৃষি শ্রমিকদের। ফলে কদর বেড়েছে শ্রমিকদের।
কারণ আলু রোপণ কাজে টাকা বেশি পাবার ফলে ধান মাড়াই ও বীজতলা তৈরিতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।
কৃষি শ্রমিক মোস্তফা জানান, রোপাআমন ধান কেটেছি মজুরি ভিত্তিতে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫০০ টাকা মজুরি পেতাম। বহিরাগত শ্রমিকরা ব্যাপক হারে ধান কাটতে এসেছিল। এজন্য অল্প সময়ের মধ্যেই ধান কাটার কাজ ইতোমধ্যে শেষের মধ্যে। এখন আলু রোপন ও জমি তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। আমরা ১৬ থেকে ১৭ জন শ্রমিক মিলে একসাথে কাজ করি। এক বিঘা আলু রোপনের জন্য ৪ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। এসব শ্রমিক প্রতিদিনে ৭ থেকে ৮ বিঘা জমিতে আলু রোপন করছেন। একেক শ্রমিক প্রতিদিনে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে আয় করছেন। এ কাজ ২০ থেকে ২৫ দিন মত চলবে বলে আলু রোপন শ্রমিকরা এপ্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
আরেক শ্রমিক মুনসুর রহমান বলেন, এবারে রোপা-আমনের ফলন ভালো হয়েছে। প্রতিবিঘায় ১৯ থেকে ২০ মণ করে আমন ধানের ফলন হচ্ছে। ধানের দামও ভালো আছে। একবিঘা জমির ধান রোপন থেকে উত্তোলন পর্যন্ত ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। কারণ সব কিছুর দাম বাড়তি। তবে, আলু রোপন করতে গিয়ে প্রান্তিক চাষিদের ঘরে ধান থাকবে না। এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে ৪০ কেজির তিন বস্তাও ব্র্যাকের আলু বীজ মিলছে না। সার ও বীজের ব্যাপক বাড়তি দাম। তিনি আরো জানান, নিজস্ব এক বিঘা আলু রোপন করতেই ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা করে খরচ হবে। আর টেন্ডারে এক বিঘা জমি রোপন করতে ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করে গুনতে হবে। কারণ ন্যায্য মূল্যে কোন সার পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি সার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
উপজেলার কামারগাঁ ইউপির কৃষক আব্দুল্লাহ জানান, চার বিঘা জমিতে রোপা আমনের ধান করে ৫০ মণ ফলন পেয়েছি। কারণ ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাব এবং পরিচর্যা না করার কারণে ফলন কম হয়েছে। তবে, ওই পরিমাণ জমিতে আলু রোপন করব। কিন্তু এখন পর্যন্ত বীজ ও সার সংগ্রহ করতে পারিনি। একবস্তা টিএসপি সারের দাম বলছে ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা করে। যে পরিমান ধান পেয়েছি বিক্রি করে টিএসপি সার জুটবে না। এমদাদুল তিন বিঘা জমিতে রোপা আমনের ধান চাষ করে ৬০ মণ ধান পেয়েছেন। কিন্তু আলু রোপনের জন্য নির্ধারিত মূল্যে সার বীজ মিলছে না তার। ওয়াসিম আকরাম- ছয় বিঘা জমিতে রোপা আমনের ধান চাষ করে ৯০ মণ ধান পেয়েছেন। আলু রোপনের জন্য কিছুই মিলছেনা।
কৃষকরা জানান, দীর্ঘ দিন ধরে আলু রোপনের আগে সিন্ডিকেট হয়। কিন্তু চলতি বছরে যে পরিমাণ সিন্ডিকেট কারসাজি শুরু হয়েছে, তা এর আগে দেখিনি। উপজেলা প্রশাসনের কোন ধরনের তদারকি না থাকার কারণে ইচ্ছে মত কারসাজি করছেন বীজ ও সার ডিলার আর ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি দোকানে বাড়তি দাম নিলেও কোন প্রতিকার নেই। দেশে কোন সরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। হাসিনা সরকারের পতন হলেও ব্যবসায়ীরা কারসাজিতেত মেতে উঠেছে। প্রতিগোযীতা করে কারসাজি শুরু করেছেন। কারসাজিতে সবাই একাকার হয়ে আছে।
গত শুক্রবার সরনজাই বাজারের বিএডিসি ও বালাইনাশক ব্যবসায়ী সজিবের দোকানে ট্রাক ভর্তি বিভিন্ন প্রকারের সার কালোবাজারের মাধ্যমে এনে প্রতি বস্তা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে বেশি নিচ্ছে। তাকে ফোন দেয়া হলে তিনি জানান, যুবদল করার কারণে একাধিক মামলা হয়েছে। বিগত সময়ে ব্যবসা করতে পারিনি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে শান্তিতে ব্যবসা করছি। আপনি নাকি চোরাই পথে সার এনে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, বাড়তি দামে কিনে আনছি একারণে বাড়তি দাম নেয়া হচ্ছে। কেউ তো লোকসান করে ব্যবসা করতে পারবে না।
উপজেলার সরনজাই এলাকা থেকে আসার পথে স্টিয়ারিং গাড়ির এক গাড়ি ব্র্যাকের বীজ পাচার করছিলেন মোহনপুর উপজেলার মোগাছি বাজারের বীজ ডিলারকারী। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, তানোর উপজেলার সরনজাই ইউপির কাসারদিঘি গ্রামের বাক্কারের কাছে বিক্রি করেছি। তবে স্থানীয় কৃষকরা জানান, আমরা বীজ পাচ্ছি না। অথচ মোগাছির ডিলাররা বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। কিন্তু প্রান্তিক কৃষকরা বীজ পাচ্ছেনা। গত শুক্রবার কালীগঞ্জ বাজারের মিজান ট্রেডার্স নামের বালাইনাশক ব্যবসায়ী মহব্বত বাহির থেকে সার এনে দোকানে নামাচ্ছিলেন। সেখানকার বেশকিছু ব্যবসায়ী ও কৃষকরা জানান, প্রকাশ্যে কালোবাজারির মাধ্যমে ট্রাকের ট্রাক সার এনে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। অথচ সার নীতিমালা লঙ্ঘন করলেও কৃষি দপ্তর একেবারে নীরব ভ‚মিকা পালন করছেন। কারণ তাদের ঘাড়ে ভ‚ত বসে আছে। বীজ সার নিয়ে মহা বেকায়দায় পড়েছেন আলু চাষিরা।
জানা গেছে, তানোর পৌর এলাকার জিওল গ্রামের পূর্ব দিকে রহিমাডাঙ্গায় আগাম জাতের আলু চাষ হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিল সংলগ্ন জমিতে আগাম আলু চাষ হয়। উপজেলার মাঠে মাঠে চলছে আলু রোপনের কাজ। কৃষাণীরা আলুর বীজ কেটে সহায়তা ও বাড়তি আয় করে থাকেন আলু রোপনের সময়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে পুরো উপজেলায় ২২ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের ধান চাষ হয়েছে। এরমধ্যে ৭৫ জাতের ধান চাষ হয়েছে ৬৩৩ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টর ৬ দশমিক ৩ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হলে ১ লাখ ৪২ হাজার ১২৮ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হবে। সেই হিসেবে চাল উৎপাদন হবে ৯৩ হাজার ৮০৪ মেট্রিকটন। উপজেলার জনসংখ্যা হিসেবে বছরে ৩৩ হাজার ৫৮০ মেট্রিকটন চালের প্রয়োজন। অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগ চালের প্রয়োজন বাকি দুই ভাগ রপ্তানি হয়। এটা শুধু রোপা আমনের হিসেব মতে।
উপজেলা কৃষি অফিসার সাইফুল্লাহ আহম্মেদ বলেন, চলতি রোপা আমন মৌসুমে যে পরিমান ধান উৎপাদন হবে তার দুই ভাগ রপ্তানি হবে। বিশেষ করে এবার রোপা আমন মৌসুমে ব্যাপক ভাবে মাঠে থাকার কারনে রোগ বালাই ছিলনা। তবে চলতি মৌসুমে আলুচাষের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ হাজার ১১৫ হেক্টর জমি। বীজের চাহিদা ২৯ হাজার ৫১০ মেট্রিকটন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫০ মেট্রিকটন। সারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, সরকারি হিসেবে সার প্রয়োগ হয়না। কিন্তু বরাদ্দ পায় সরকারি হিসেবে। কিন্তু সার ও বীজের বাড়তি দামের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে লিখিত অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।