শত বছর পুরনো রেলক্রসিংয়ে ছিলো না গেটম্যান
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:৪৪:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ২৫ বার পড়া হয়েছে
কুমিল্লায় অরক্ষিত একটি রেল গেটে ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার চালকসহ ৭ যাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন শাহিনুর আক্তার নামে অন্তসত্বা এক গৃহবধূসহ ৪ নারী। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১ জন। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সকাল ১০টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের জেলার বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর রেল ক্রসিং এলাকায় মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এদিকে, দুর্ঘটনা তদন্তে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্মকর্তারা স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে পড়েন। স্থানীয়দের অভিযোগ- শত বছর যাবৎ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বারবার আশ^াস দিলেও এ গেটটি ছিল অরক্ষিত। নেই গেটম্যান ও সিগন্যাল। তাই এখানে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসী জানান, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর সূবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি দ্রুতগতিতে ঢাকা অভিমুখে বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর-বাকশিমুল সড়কের রেল ক্রসিং অতিক্রম করছিল। এসময় কালিরবাজার থেকে বাকশিমুল অভিমুখি যাত্রীবোঝাই ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশা হঠাৎ রেল লাইনে উঠে পড়ে। এসময় দ্রুতগামী ট্রেনটির মুখে বিকট শব্দে আটকে অনেক দূরে নিয়ে যায় দুর্ঘটনাকবলিত অটোরিকশাটি। দুর্ঘটনার পর পুরো রেল রাস্তা জুড়ে অটোরিকশাটির খন্ড খন্ড টুকরো ও যাত্রীদের সাথে থাকা ব্যবহৃত বিভিন্ন মালামাল রেল লাইনের পাশে এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক যাত্রীর শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। যাত্রীদের রক্তে রেল লাইনের স্লিপার রঞ্জিত হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে ৭ জনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলো- জেলার বুড়িচং উপজেলার বাকশিমুল গ্রামের মৃত মনছুর আলীর ছেলে আলী আহাম্মদ (৭৭), মনির হোসেনের স্ত্রী ৮ মাসের অন্তস্বত্তা শাহীনুর আক্তার (৩৩), আলী আশরাফের স্ত্রী সফরজান বেগম (৬৫), মৃত আবদুল মালেকের স্ত্রী লুৎফা বেগম (৬০), মৃত তৈয়ব আলীর ছেলে অটোরিকশার চালক শাহজাহান মিয়া সাজু (৪০), খোদাইতলী গ্রামের মৃত ফজলু মিয়ার স্ত্রী হোসনেয়ারা বেগম (৬০) এবং একই গ্রামের মৃত আছমত আলীর ছেলে রফিজ উদ্দিন (৬৫)। নিহতদের মরদেহ নিজ নিজ বাড়িতে নেয়ার পর এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
বুড়িচং থানার ওসি আজিজুল হক বলেন, বুড়িচং উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ কালিকাপুর-বাকশিমুল সড়কের আশপাশে কয়েকটি বাজার ও কলেজ-মাদ্রাসা থাকলেও ওই রেল ক্রসিংয়ে কোনো গেইট ছিল না। নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় একসাথে ৭ জন নিহত হওয়ার পর জনগণের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।
লাকসাম রেলওয়ে থানার ওসি এমরান হোসেন জানান, নিহতদের পরিবারের দাবির প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশগুলো স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে রেলওয়ে রসুলপুর স্টেশনের স্টেশনমাস্টার প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী বাদী হয়ে রেলওয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
তদন্ত কামটি গঠন: রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিভিশনাল ম্যানেজার এবিএম কামরুজ্জামান জানান, ঘটনার তদন্তে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহকারী পরিবহন কর্মকর্তাকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটির অন্যরা হলেন, সহকারী কমান্ডেন্ট, সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী ও সহকারী সিগনাল ইঞ্জিনিয়ার। কমিটিকে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, রেল ক্রসিংটি আনঅথারাইজড ছিল। হঠাৎ করে অটোরিকশা যাত্রী নিয়ে লাইনের উপর উঠে যাওয়ায় এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের রেল ক্রসিংয়ে গেইট ও প্রহরী নিয়োগের চিন্তাভাবনা করছে।
অনাগত সন্তানের মুখ দেখা হলো না শাহিনুরের: ১০ বছরের ছেলে সৈকতকে স্কুলে পাঠিয়ে স্থানীয় গাজীপুর বাজারে ডাক্তারের কাছে রওনা হন শাহিনুর। ফিরে এসে দুপুরে ভাত খাওয়ানোর কথা ছিল সৈকত ও স্বামী মনিরকে। অনাগত সন্তানের চিকিৎসা সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রতি সপ্তাহের মতো গাজীপুর বাজারে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলেন শাহিনুর। এক অটোরিক্সায় শাহিনুর সহ ছিলেন আরও ৮জন।
বাড়ি থেকে একটু দূরে কালিকাপুর লেভেলক্রসিংয়ে গেলেই ঘটে দুর্ঘটনা। লেভেল ক্রসিংয়ে উঠতেই ঢাকাগামী বিরতহীন সুবর্ণ এক্সপ্রেস এর দ্রুতগামী ট্রেনের ধাক্কায় চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় শাহিনুরদের বহনকারী অটোরিকশাটি। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান শাহিনূরসহ ৭ জন। শাহিনুরের মৃত্যুতে তার বাড়িতে শোকের মাতম। শাহিনুরের স্বামী মনির হোসেন জানান, আমার অনাগত সন্তানের মুখ দেখা আর হলো না। শাহীনুর আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েই ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলো। কথা ছিল দুপুরে একসাথে ভাত খাব। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
শাহিনুরের শ্বশুর ইউসুফ মিয়া জানান, আমার ছেলের বউ খুব ভালো ছিল। আমার মেয়ের মত ছিল। আমার নাতিনের মুখ দেখতে পারলাম না। ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশার ৭ জনই মারা গেলো। এটা মেনে নেয়া যায় না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গেটে লোকজন রাখলে এমন মৃত্যু হতো না।
শত বছর পুরনো রেলক্রসিংয়ে ছিল না বেরিয়ার-গেটম্যান: চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সকল প্রান্তের রেল যোগাযোগের অন্যতম মধ্যবর্তী স্থান কুমিল্লা। দেশের উচ্চগতির এই রেলপথে গলার কাঁটা অবৈধ রেলক্রসিং বা লেভেল ক্রসিং। এসব অবৈধ রেলক্রসিংয়ের একটি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশীমূল-কালিকাপুর রেলক্রসিং। এই ক্রসিংটি শতবছর আগের বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ ওই রেলক্রসিংটি দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ এবং শত শত যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ওই রেলক্রসিংটি বৈধ করে সেখানে নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি এতদিনেও। ফলে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির আশংকা থাকছে। সর্বশেষ গতকালের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৭ জন।
স্থানীয় বাসিন্দা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা আবদুল ওহাব বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির ফলে ৭টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। তারা সেখানে গেটম্যান দিলে এবং বেরিয়ার তৈরি করলে এখানে এতো প্রাণহানিগুলো ঘটতো না। খবর পেয়ে কুমিল্লা থেকে রেলওয়ে কর্মর্তারা ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ লোকজন এ অরক্ষিত গেটে নিরাপত্তা ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি জানিয়েছে। অবিলম্বে ওই রেলক্রসিংয়ে গেইট নির্মাণ, সিগনালসহ নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের দাবি না দেয়া হলে রেল চলাচল বন্ধের হুমকী দিয়েছে।
কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (পথ) মো. লিয়াকত আলী বলেন, দুর্ঘটনার ওই জায়গাটি এলজিইডির। এলজিইডি উদ্যোগ নিলে রেলক্রসিংটি বৈধ করা যেত। আমরা আজকে সেখানে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগিয়েছি। সেখানে গেটম্যান এবং বেরিয়ার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে।