কেমন গেলো অন্তর্বর্তী সরকারের ৩ মাস
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ০৭:৩৮:৪৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ২০২৪ ৮ বার পড়া হয়েছে
অন্তর্বর্তী সরকারের তিনমাস পূর্ণ হলো শুক্রবার (৮ নভেম্বর)। দায়িত্ব নেওয়ার বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এই তিন মাস পার করেছে এ সরকার। এর মধ্যে কোনোটি দৃশ্যমান, আবার কোনোটি অদৃশ্য চ্যালেঞ্জ। প্রথমত দেশের মানুষের নজিরবিহীন সমর্থন এবং দ্বিতীয়ত উন্নয়ন সহযোগীসহ বহির্বিশ্বের সমর্থন ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার আশ্বাস। কিন্তু তিনমাসে সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগানো যায়নি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।
তিন মাসে বড় সাফল্য হলো- বিভিন্ন মামলায় সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের অনেককে গ্রেপ্তার এবং তাদের দ্রæত বিচারের আওতায় আনা। গুম-খুনের তদন্ত, একতরফা ও অনিয়মের ভোটে নির্বাচিতদের নিয়ে গঠিত সংসদ বিলুপ্ত করা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ, পুলিশ, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিতদের একাংশকে সরিয়ে দিয়ে বিচারের সম্মুখীন করাও এই সাফল্যের মধ্যে পড়ে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছুটা শৃঙ্খলা আনাটাও এই সরকারের অন্যতম সাফল্য। এই মূল্যায়ন অনেকের। তবে তিন মাসে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার কথাও আলোচনায় আছে।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গতানুগতিক ও আমলাতান্ত্রিক ধারার কারণে সাফল্য সীমিত বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে- একজন উপদেষ্টাকে অনেক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার কারণে কাজের অগ্রগতি কম। প্রশাসন এখনো আগের সরকারের দোসরমুক্ত হতে পারেনি। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে যারা অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তারা এখনো প্রতিকার পাননি। এ বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বলেও ভুক্তভোগীরা মনে করছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক নয়। তবে কোনো সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা বিচারে এটি যথেষ্ট সময় নয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত তিন মাসে অন্তর্র্বতী সরকার কার্যকর ভ‚মিকা রেখেছে বলে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তিন মাসে বর্তমান সরকার অবশ্যই কার্যকর ভ‚মিকা রেখেছে। তারা অনেক কাজ করেছে।
গত ২২ অক্টোবর শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদচ্যুতি, ৭২-এর সংবিধান বাতিল, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করাসহ পাঁচ দফা দাবিতে সময়সীমা বেঁধে দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের আলটিমেটাম শেষ হলেও এক ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো দাবিই পূরণ হয়নি।
এরমধ্যে জাতীয় পার্টির অফিসে আগুন দেয়াকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সমালোচনার সৃষ্টি হয়। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ এর সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন সমন্বয়ক সারজিস আলম।
এ ছাড়া সমালোচনার মুখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ১১টি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে করা রিটও প্রত্যাহার করা হয়। সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলামের ‘মেট্রোরেলে আগুন না দিলে কিংবা পুলিশ হত্যা না করা হলে, এত সহজে বিপ্লব অর্জন করা যেত না’ আপত্তিকর বক্তব্যের কারণেও বিপাকে পড়তে হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে। পরে তাকে শোকজ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক বলেন, আমাদের কয়েকটি সিদ্ধান্ত একটু সময় নিয়ে করা উচিত ছিল। জাতীয় পার্টির অফিসে আগুন দেয়ার ঘটনার আগে আহŸায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুকে পোস্ট না করলে হয়তো সমালোচনার সৃষ্টি হতো না। এছাড়া আরেকটু চিন্তাভাবনা করে রিট করা গেলে সমালোচনা হতো না। হাসিব আল ইসলামের বক্তব্য নিয়েও আমরা অনেকটাই বিপাকে পড়েছি। তবে আশা করি, সব সংকট কাটিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণে কাজ করবে।
ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসন থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অবশ্যই কঠিন এবং সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়া এত বেশি দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, আমাদের মূল কাজে ফোকাস করা কঠিন হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাদের চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছেন।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, তিন মাসে এ সরকার যথেষ্ট অর্জন করেছে। তারা সিনসিয়ার ছিল, কোনো কেলেঙ্কারির কথা শুনেছেন? আমরা বলতে পারি, মোটাদাগে ৫টা কাজ হয়েছে।
গত ১৭ অক্টোবর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে চলা হত্যাকান্ডের অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্র্বতী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ঘোষণা দেয়।
বিচারকাজ শুরুর দিনেই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
অন্যদিকে, গত দেড় মাসে এক হাজার ছয় শর বেশি অভিযোগ গুমসংক্রান্ত ঘটনা তদন্তে সরকার গঠিত কমিশনে জমা পড়েছে। ৩৮৩টি অভিযোগ যাচাই করে কমিশন জানিয়েছে, এর মধ্যে ১৭২টি অভিযোগই এসেছে র্যাবের বিরুদ্ধে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে গুমসংক্রান্ত কমিশন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, এসব অভিযোগ তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ডাকতে সমন জারি করা হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দেশের ৫৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েরই উপাচার্য পদ পূরণ করা হয়েছে। তবে এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদ শূন্য রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত উপাচার্য নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি চার বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ২৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এবং ১৮ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া শেষ হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্কুল-কলেজ স্বাভাবিকভাবেই চলছে। তবে নতুন শিক্ষাক্রম থেকে আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে আসায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা খুশি। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষকরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে এখনো সরব। স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন স্থগিত করলেও দূর হয়নি অস্বস্তি।
এদিকে, আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাত ছিল অন্যতম ভুক্তভোগী। সুশাসনের এতটাই অভাব ছিল যে স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে এ দেশের ব্যাংকিং খাত এত বেশি সমস্যার মুখোমুখি আর কখনো হয়নি। শেয়ারবাজারের উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) টাস্কফোর্স গঠন করেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১৪ বছর আগে করা ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বিধান বৃদ্ধি (বিশেষ আইন) আইন’ বাতিল করেছে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। পাশাপাশি এই আইনের অধীনে করা সব চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করতে পর্যালোচনা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে ‘বিতর্কিত’ বিশেষ বিধান আইনের অধীনে অনুমোদিত ৪৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা একটি ভাঙাচোরা অর্থনীতির দায়িত্ব পেয়েছি। এটাকে সংস্কার করা এত সোজা নয়। অনেক কঠিন কাজ। তার পরও অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব আমরা করে যেতে চাই।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা এখন অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তা যদি কাটানো না যায়, তাহলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের পথে হাঁটবেন না।