সাদাবাড়ির লড়াই
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:৫৩:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪ ৩০ বার পড়া হয়েছে
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টানটান উত্তেজনা আমেরিকায়। ডেমোক্র্যাট নেত্রী কমলা হ্যারিস নাকি রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প? সমস্ত ভোটসমীক্ষা, বিশেষজ্ঞদের কাটাছেঁড়াকে পিছনে ফেলে শেষ হাসি কে হাসবেন সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব। ভারত, চিন, বাংলাদেশ, ইজরায়েলের মতো একাধিক দেশের পাশাপাশি ভাইস প্রেসিডেন্ট বনাম প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই লড়াইয়ে তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেনেরও।
এই মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী লড়াই জারি রয়েছে যুযুধান দুদেশের মধ্যে। কমলা বা ট্রাম্প,মসনদে যেই বসুন না কেন, দুদেশের সঙ্গেই কূটনৈতিক সমীকরণ বদলে যেতে পারে আমেরিকার। আর এই বদলই হয়তো আগামিদিনে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ইউক্রেনের।
ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২। বেজে ওঠে রণদুন্দুভি। ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ঘোষণা করে দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সীমান্ত পেরিয়ে বাঁধভাঙা জলের মতো ঢুকে পড়ে রুশ ফৌজ। দুই প্রাক্তন সোভিয়েত সদস্যভুক্ত দেশের মধ্যে শুরু হয় প্রবল যুদ্ধ। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশের জওয়ানদের সঙ্গে কাঁধ মেলান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই খেরসান, বাখমুটের মতো ইউক্রেনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নেয় মস্কো। ‘নরককুণ্ডে’ পরিণত হয় রাজধানী কিয়েভ। শুরুর দিকে মনে হয়েছিল খুব সহজেই হয়তো ‘গোলিয়াথ’ রাশিয়ার কাছে হার মানবে জেলেনস্কির ‘লিলিপুট’ বাহিনী।
কিন্তু না বাস্তবে সেটা হলো না। বরং মাস কয়েকের মধ্যেই কাউন্টার অফেন্সিভ বা পালটা মার দিয়ে রণক্ষেত্রের ছবিই পালটে দিল ইউক্রেনীয় সেনা। এখন পর্যন্ত কিয়েভ দখল করতে পারেনি রাশিয়া। উলটে বাখমুটের মতো হারানো জমি ফিরে পেলেন জেলেনস্কি। এখানেই প্রশ্ন ওঠে কার মদতে এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠল ইউক্রেন? উত্তরটা নিঃসন্দেহে আমেরিকা। দুঃসময়ে বন্ধুর ত্রাতা হয়ে পরোক্ষভাবে যুদ্ধের ময়দানে নাম লেখায় ওয়াশিংটন।
আড়াই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে যুদ্ধের। এই দীর্ঘ সময়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করতে একের পর এক বড় অংকের সামরিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গোলাবারুদ, সাঁজোয়া গাড়ি, মিসাইল বিধবংসী ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র- সব কিছু ঢেলে দিয়েছেন ইউক্রেনের ঝুলিতে। শুধু তাই নয়, নীতি বদলে কিয়েভকে দূরপাল্লার মিসাইল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ‘আগ্রাসী’ আমেরিকা। অত্যাধুনিক এই ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার অন্দরে ঢুকে ৩০৬ কিলোমিটার পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। এছাড়া জেলেনস্কির প্রতি সংহতি প্রদর্শন করতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আচমকাই ইউক্রেনে চলে গিয়েছিলেন বাইডেন।
একাধিকবার কিয়েভে দেখা গেছে, মার্কিন বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকেও। রাশিয়ার আক্রমণের নানা রক্তাক্ত ছবি ঘুরে দেখেছেন তিনি। গত বছরের হ্যালোইন উদযাপনে ব্লিঙ্কেনের খুদে ছেলেকে দেখা গিয়েছিল জেলেনস্কির মতো পোশাকে। গায়ে জড়ানো ছিল ইউক্রেনের পতাকা। আনন্দ-উৎসবেও যে বন্ধুকে ভোলেনি হোয়াইট হাউস এটা ছিল তাঁর প্রমাণ।
আর এই বন্ধুত্বেই আশায় বুক বেঁধেছেন লাখ লাখ ইউক্রেনীয়। আমেরিকার সাহায্যে রণক্ষেত্রে জয় পাবে তাদের দেশ। যুদ্ধের কালো মেঘ সরে গিয়ে শান্তি ফিরবে ইউক্রেনে। এই পরিস্থিতিতে তাদের নজর প্রায় ৫ হাজার মাইল দূরের বহুল চর্চিত মার্কিন নির্বাচনের উপর। বাইডেনের নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটরা যেভাবে কিয়েভের প্রতি সংহতি দেখাচ্ছেন ট্রাম্পের রিপাবলিকানরা কি সেই পথে হাঁটবেন?
এদিকে, ইউক্রেনকে বিপুল অর্থের সামরিক সাহায্যের জন্য ওয়াশিংটনের অন্দরেই চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কারণ বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতিতে জেরবার আমেরিকা। বিভিন্ন রিপোর্ট মোতাবেক ভাঁড়ারে টান পড়েছে পরমাণু শক্তিধর দেশটির। তাই নির্বাচনের দামামা বাজতেই ইউক্রেনকে সহায়তা করা নিয়ে বাইডেনের পক্ষ থেকে সমর্থন কমতে থাকে। তার পর নানা জল্পনার মাঝেই প্রেসিডেন্টের দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান বর্ষীয়ান ডেমোক্র্যাট নেতা। তার উত্তরসূরি হয়ে ‘রেস টু হোয়াইট হাউসে’ শামিল হন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা। বহুবার নির্বাচনী প্রচারে তার বক্তব্যে উঠে এসেছে ইউক্রেনের যন্ত্রণার কথা। তাই প্রেসিডেন্টের গদিতে বসতে পারলে বন্ধু দেশকে সাহায্য করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। বার বার বলেছেন ইউক্রেনের পাশে থাকতে পেরে গর্বিত তিনি। এবং আগামিদিনেও কিয়েভের পাশেই থাকবেন।
কমলা হ্যারিসকেই পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চান ইউক্রেনীয় তরুণী ইনা। রুশ মিসাইলে বিস্তর ক্ষতি হয়েছে তার দোকানের। সেখানকার ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করতে করতেই বিবিসির সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আগামিদিনে ইউক্রেনের ভাগ্য নির্ধারণ হবে আমেরিকার নির্বাচনে। সেদেশের নাগরিকদের হাতেই রয়েছে আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের আশা কমলা হ্যারিস জিতলে উনি এদেশের পাশে দাঁড়াবেন। আমরা ওঁর জয় চাই। আমরা আমাদের শত্রুকে ধূলিসাৎ করতে চাই। তাই এই নির্বাচন ও তার ফলাফল নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
ইনার মতোই উদ্বিগ্ন রুশ ফৌজের বিরুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে লড়াই করা হাজার হাজার ইউক্রেনীয় জওয়ান। কারণ যুদ্ধে লড়াই করার মতো রসদ ফুরিয়ে আসছে তাদের। চলতি বছরেই আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্বের কাছে সমরাস্ত্রের জন্য হাহাকার করতে দেখা গেছে জেলেনস্কিকে। দুর্বল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের জন্য মাস তিনেক আগে রুশ মিসাইলের আঘাত প্রতিহত করতে পারেনি তার ফৌজ। যা আছড়ে পড়েছিল এক শিশু হাসপাতাল-সহ জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। প্রাণহানি ঠেকাতে পারেননি জেলেনস্কি। সেই দগদগে ক্ষত নিয়েই গত সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকায় গিয়েছিলেন তিনি। অস্ত্রের জোগান নিয়ে বৈঠকে বসেন বাইডেন ও কমলার সঙ্গে।
এই সফরে জেলেনস্কির সাক্ষাৎ হয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্পের সঙ্গেও। কিন্তু সাহায্যের প্রতিশ্রুতির বদলে কেবলই শান্তির পথে ফেরার বার্তা দিয়েছিলেন রিপাবলিকান নেতা। এখানেই উঠে আসছে আর এক সমীকরণ। পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের নমনীয় মনোভাবের কথা বিশ্বের অজানা নয়। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ২০১৮ সালে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন ট্রাম্প। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। ঐতিহাসিক সেই বৈঠকের পর কিছুটা হলেও বরফের আস্তরণ সরেছিল শক্তিধর দুদেশের সম্পর্ক থেকে। তার পর কেটে যায় দীর্ঘ সময়। ২০২০ সালে প্রেসিডেন্টের গদি হারান ধনকুবের ট্রাম্প। ২০২১ সালে মসনদে বসেন বাইডেন। পরের বছরই যুদ্ধ লাগে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে। ফের আমেরিকার সঙ্গে সংঘাত তীব্র হয় পুতিনের দেশের।
আর এই ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাইডেনের বিরোধিতা করতে গিয়ে পুতিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখা গিয়েছে ট্রাম্পকে। এছাড়া রুশ প্রেসিডেন্টের হাতে জমি তুলে দিয়ে ইউক্রেনকে শান্তির পথে ফেরার বার্তাও দিয়েছেন তিনি। কারণ ট্রাম্প মনে করেন, ক্রাইমিয়া এবং দোনবাসের সীমান্ত এলাকাগুলো দখল করতে চায় রাশিয়া। আর ওই এলাকার বাসিন্দারা রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে খুশিই হবেন। তাই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ইউক্রেনকেই সমঝোতা করতে পরামর্শ দেন তিনি। বিতর্কিত এলাকাগুলো পুতিনের হাতে তুলে দিলেই নাকি যুদ্ধ থেমে যাবে। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসলে জেলেনস্কি আর পুতিনকে আলোচনার টেবিলে আনতে পারবেন ট্রাম্প। শান্তি বৈঠকের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার দাবি করেছেন তিনি।
কিন্তু এত সহজে রাশিয়াকে জমি ছেড়ে দিতে নারাজ ইউক্রেন। কোনও অর্থেই আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে মাথা নত করবেন না জেলেনস্কি। বিশ্লেষকদের মতে, এই কারণেই ট্রাম্পের বদলে কমলার দিকে ঝুঁকেছেন ইউক্রেনীয়রা। কিন্তু এই নির্বাচনে কমলা হ্যারিস বাজিমাত করলেও গলায় কাঁটা ফুটতে পারে কিয়েভের। কারণটা হল মার্কিন কংগ্রেস বা আমেরিকার আইনসভা। যার উচ্চকক্ষ সেনেট ও নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস। এই মুহূর্তে উচ্চকক্ষ রয়েছে ডেমোক্র্যাটদের দখলে। নিম্নকক্ষে সংখ্যা গরিষ্ঠতা রিপাবলিকানদের। কোনও আইন প্রণয়ন বা বিল পাস করাতে গেলে এই দুকক্ষেরই সম্মতি প্রয়োজন। প্রেসিডেন্টের কোনও বিল আটকে দেওয়ারও ক্ষমতা রয়েছে মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণেতাদের। চলতি বছরেই ইউক্রেনের জন্য ঘোষিত সামরিক প্যাকেজ সংক্রান্ত একটি বিল আটকে যায় হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে।
কিন্তু কিয়েভের হাত ছাড়েননি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেন। পরে প্রেসিডেন্টের আর্থিক তহবিল থেকে জেলেনস্কির দেশকে সাহায্য করেন তিনি। ফলে কমলা জিতলে একটা আশঙ্কা থেকেই যাবে। সেনেট বা হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস যদি রিপাবলিকানদের দখলে থাকে তাহলে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে বেশ বেগ পেতে হবে কমলা হ্যারিসকে। এই নির্বাচনে জিতলে প্রথম মহিলা মার্কিন প্রেসিডেন্টের খেতাবও জিতবেন তিনি। ফলে দক্ষ হাতে দেশ চালিয়ে বাড়তে থাকা মুদ্রাস্ফীতিতে হ্রাস টানতে পারেন কিনা সেদিকেই নজর থাকবে সকলের। বাইডেনের মতো খোলা হাতে তিনিও ইউক্রেনকে কতটা সাহায্য করবেন আগামিদিনে সেটাই দেখার।
আজ মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) মার্কিন মুলুকে ভোটের দিন হলেও, ৪৭টি প্রদেশে অনেক আগেই ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। একে বলে ‘আর্লি ভোট’। লাখ লাখ মানুষের ভোটদান হয়ে যাওয়ার পরে যে সর্বশেষ জনমত সমীক্ষা প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় টক্কর চলছে ট্রাম্প ও কমলার মধ্যে। কয়েকটি ভোটসমীক্ষা মোতাবেক আবার রিপাবলিকান নেতার থেকে পাল্লা ভারী ডেমোক্র্যাট নেত্রীর। তাই এই মুহূর্তে কমলার জয় সুনিশ্চিত করতে হাজার হাজার সমর্থকের মতো হয়তো প্রার্থনা করছেন ইনার মতো ইউক্রেনের লাখ লাখ নাগরিকও।