ফুলবাড়ী ট্রাজিডির ১৮ বছর আজ
১৮ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ৬ দফা চুক্তি
- সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:৪৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৪ ৬৫ বার পড়া হয়েছে
দিনাজপুর ১৩টি উপজেলার ৪৫ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ী-পার্বতীপুরসহ ছয়টি উপজেলা। সেই উপজেলার খনি অধ্যুষিত ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর উপজেলা। ফুলবাড়ী পৌরসভা শহরসহ বৃহৎ এলাকাজুড়ে উন্নতমানের কয়লার স্তূপ অনুসন্ধানে পায় ‘এআইএম’ কোম্পানি । জিসিএম লন্ডনে স্টক এক্সচেঞ্জের অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট মার্কেটে (এআইএম) তালিকাভুক্ত একটি মাইনিং কোম্পানি যখন দাবি করে ফুলবাড়ীতে ৫৭২ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার মজুদ আছে, তখনি এশিয়া এনার্জি উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা তোলার সার্বিক প্রস্তুতি নেয়। তখনি ফুলবাড়ী- বিরামপুর-পার্বতীপুর-নবাবগঞ্জ এই ৪ উপজেলার মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
আজ সোমবার (২৬ আগস্ট) ফুলবাড়ী ট্রাজিডি দিবসের ১৮ বছর। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরুদ্ধে উপজেলার হাজার হাজার মানুষ ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) গুলিতে ৩ যুবক- বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র আবু সালেহ মো.তরিকুল ইসলাম (২০),৬ষ্ঠ শ্রেণির দু’জন আমিনুল ইসলাম আমিন (১৫) ও মো. সালেকিন (১৭) নিহত এবং আহত হন দু’শতাধিক নারী-পুুরুষ। এরমধ্যে গুলিবিদ্ধ প্রদীপ সরকার দীর্ঘদিন ভুগে মারা গেছেন। শ্রীমান বাস্কে গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন ভোগেন,আর এক গুলিবিদ্ধ বাবলু রায়ের অবস্থা এখন সংকটাপন্ন।
উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লাখনির কয়লা তোলার চক্রান্ত বন্ধের দাবিতে তেল- গ্যাস -খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ -বন্দর -রক্ষা জাতীয় কমিটি ওইদিন বহুজাতিক কোম্পানী এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়। ফুলবাড়ী সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন সমর্থন দিয়ে কয়লাখনি এলাকা ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং এশিয়া এনাজির কার্যালয় ঘেরাও করতে যান। ছোট যমুনা ব্রিজের পূর্ব পাশে পুলিশ-বিডিআর ওই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই আমিন, সালেকিন ও তরিকুল ইসলাম নামের তিন যুবক নিহত হয়।শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের হরতাল- অবরোধ। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ফুলবাড়ীর ওপর দিয়ে বাস, ট্রেন চলাচলসহ সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এশিয়া এনার্জির সুবিধাভোগী (দালাল) হিসেবে চিহ্নিত কয়েক ব্যক্তির বাড়িঘর ভাংচুর চালিয়ে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুদ্ধ জনতা। স্থবির হয়ে পড়ে ফুলবাড়ীর জীবনযাত্রা ।
একপর্যায়ে সে সময় বিএনপি-জামায়াত ৪ দলীয় জোট সরকারের সাথে আন্দোলনকারীদের ৬ দফা সমঝোতা চুক্তি গণআন্দোলনের মুখে ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় স্বাক্ষরিত হয়। সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনু এবং তেল গ্যাস জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আন্দোলনকারীদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন ।
সে সময় বিএনপি-জায়ামাত জোট সরকার ৬ দফা চুক্তির আংশিক সরকার বাস্তবায়ন করলেও এখন রয়ে গেছে এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে বহিষ্কার, দেশের কোথাও কোন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি বাস্তবায়ন না করার মতো বেশ কয়েকটি দফা। যেগুলো বাস্তবায়নের দাবিতে এখনও আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আন্দোলনকারীদের নামে এশিয়া এনার্জির দায়ের করা পৃথক দুটি মামলা।
তেল – গ্যাস – খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ -বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির এবারের দাবিসমূহ ১. ফুলবাড়ীর ৬ দফা চুক্তির প‚র্ণ বাস্তবায়ন ২. ফুলবাড়ী নেতৃবৃন্দের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার ৩. এশিয়া এনার্জিকে (জিসিএম) দেশ থেকে বহিষ্কার ৪. ২৬ আগস্ট ২০০৬ সালে জনগণের উপর গুলি ও হামলাকারীদের বিচার ৫. এশিয়া এনার্জির সকল পর্যায়ের দালালসহ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিরোধীদের প্রতিহত করা ৬. উন্মুক্ত কয়লাকনির চক্রান্ত বন্ধ ৭. ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানে শহীদদের হত্যার নিরপেক্ষ তদন্তসহ বিচার ইত্যাদি।
দিনটিকে তেল- গ্যাস -খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ -বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ‘‘ফুলবাড়ী দিবস’’ এবং ফুলবাড়ীর সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন ‘আমরা ফুলবাড়ী বাসী ’ “ফুলবাড়ী শোক দিবস’’ হিসেবে ,এছাড়া ফুলবাড়ী দোকান কর্মচারি ইউনিয়ন, মটরশ্রমিক ইউনিয়ন, হোটেল কর্মচারি ইউনিয়নসহ পৃথক পৃথকভাবে কর্মসূচি নিয়ে দিবসটি পালন করবে। কর্মসূচির মধ্যে আছে সকালে কালো পতাকা উত্তোলন, ‘আসাত’ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন, প্রতিবাদ সভা,মানববন্ধন ,মুখে কালো কাপড় লাগানো (যাতে লেখা থাকবে কয়লাখনি চাইনা), কালো ব্যাজ ধারণ, র্যালি, স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, স্মরণসভা এবং মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও পেগোডায় দোয়া এবং বিশেষ প্রার্থনা।
সদ্য বিদায়ী পৌর মেয়র মাহমুদ আলম লিটন ‘বাংলা টাইমসকে’ বলেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলন চলমান আছে। যে খনি মানুষের কল্যাণের থেকে অকল্যাণ বেশি করবে, তা কখনো জনগণ করতে দেবে না। দিবসটি উদযাপনের জন্য শোক র্যালি, ‘আসাত’ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
জেলা বিএনপি’র উপদেষ্টা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. খুরশিদ আলম মতি ‘বাংলা টাইমসকে’ বলেন, ৬ দফা চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই।মানুষের যানমাল বিলীন করে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে দেবেনা আন্দোলনরত ফুলবাড়ীবাসী। ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ক এবং ফুলবাড়ী পৌরসভার সাবেক মেয়র মুরতুজা সরকার মানিক ‘বাংলা টাইমসকে’ বলেন, ‘এশিয়া এনার্জি আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখতেই মিথ্যা মামলা দিয়েছে। দুটো মামলারই (ক্ষতিপূরণের ১শ’ কোটি টাকা আর ভাংচুরের)আমাকে এক নম্বর আসামী করা হয়েছে। কয়লা খনির সুবিধা হচ্ছে সাময়িক আর এলাকার জমির ফসলের সুফল পাবে জনগণ অনন্তকাল।সুতরাং এশিয়া এনার্জিকে কোনোভাবেই মাঠে নামতে দেয়া হবে না।’
ফুলবাড়ী তেল- গ্যাস -খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ -বন্দর -রক্ষা জাতীয় কমিটি আহবায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল ‘বাংলা টাইমসকে’ বলেন, ‘ স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে।এই মুহূর্তে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র এবং জনতার অন্তবর্তীকালীন সরকার যেহেতু নতুন, সেহেতু এই সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছি ৬ দফা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হোক।আগামী দিনের সরকার বিগত সরকারের মত দেশের স্বৈরাচারী যে মনোভাব দেখিয়েছে তা থেকে সরে আসবে। দেশ এবং জাতি যখন উন্নয়নের স্রোতধারায় এগিয়ে যাবে, ঠিক সে সময় আমাদের দাবিগুলো আমরা জোরালো ভাবে তুলে ধরবো। এ সম্পদ জাতির স্বার্থ ছাড়া কোনো বহুজাতিক লুটেরাদের ভোগ করতে দেয়া যাবে না।