ঢাকা ০৩:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আলাদীনের চেরাগ বেনজীরের ঘরে

বিশেষ প্রতিবেদক
  • সংবাদ প্রকাশের সময় : ০২:৪৪:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ মার্চ ২০২৪ ৩৬২ বার পড়া হয়েছে
বাংলা টাইমস অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ঢাকা- মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ফরিদপুরের ভাঙ্গা চৌরাস্তা থেকে টেকেরহাট হয়ে সামনে গেলেই গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রাম। নিভৃত এই পল্লীর মাঝে গড়ে উঠেছে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামে এক অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র। এখানে একরাত থাকতে গেলে গুনতে হবে ১৫ হাজার টাকা । সাভানা ইকো রিসোর্ট ঘুরে দেখা গেছে একই সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর হাতে গড়া আভিজাত্যের অপরূপ মিশেল । বিশাল আকৃতির ১৫টি পুকুরের চারপাশে গার্ড ওয়াল, পানির কৃত্রিম ঝরনা, দৃষ্টিনন্দন ঘাট ও আলোর ঝলকানি ।

পার ঘেঁষে রয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কটেজ । বিদেশি শিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি স্থাপত্য নকশা তাতে শোভা পাচ্ছে । কটেজের ভেতর থেকে পুকুর পর্যন্ত যেতে মাটিতে পা ফেলাতে হবে না। সরাসরি কটেজ থেকে কাচে ঘেরা আবরণ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় শান-বাঁধানো ঘাটে । সাভানা ইকো রিসোর্টের পরিধি এতটাই বড়- সাহাপুর গ্রামের নাম লিখে গুগলে সার্চ দিলে এই রিসোর্টটিই আগে ভেসে ওঠে পর্দায় ।

এক হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত সাভানা ইকো রিসোর্টের বিভিন্ন জায়গায় বানানো হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়। রয়েছে সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিং পুলও। আছে ভিয়েতনামি নারকেলগাছসহ বিভিন্ন ফলফলাদির গাছ । রয়েছে উন্নতমানের সাউন্ড সিস্টেম ও বিশাল আকৃতির কনসার্ট হল ।

দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একক পরিবারের জন্য বানানো এসব কটেজের পেছনে ব্যয় হয়েছে অর্ধকোটি টাকারও বেশি । যুগলদের কাছে কটেজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রিসোর্টের ভেতরে এখন আরও ৫০টি কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে । রিসোর্টের নিরাপত্তায় পাশেই ‘ বিশেষ ’ পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়েছে। সরকারি খরচে যাতায়াতের জন্য বানানো হয়েছে ৫ কিলোমিটারের বেশি পাকা সড়ক ।

দেশে নজিরবিহীন এ রকম আভিজাত্যে ঘেরা পর্যটন স্পটটির মালিকদের নাম শুনলে অঅতকে উঠবেন না। রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ( আইজিপি) ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবার এর মালিক ।

সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক( এমডি) বেনজীরের বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এবং পরিচালক ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ।

শুধু এই এক ইকো রিসোর্টই নয়, পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড় । অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের নামে অন্তত ছয়টি কম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে । এর পাঁচটিই নিজ জেলা গোপালগঞ্জে । জেলা সদরের সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা পাওয়া গেছে ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে বেনজীর আহমেদের রয়েছে অঢেল সম্পদ । রয়েছে দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার কাছেই দামি এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি । দুই মেয়ের নামে রয়েছে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের দুই লাখ শেয়ার । পূর্বাচলে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার বাজার মূল্য কম হলেও ৪৫ কোটি টাকা । একই এলাকায় রয়েছে ২২ কোটি টাকা দামের ১০ বিঘা জমি রয়েছে ।

এই বিপুল সম্পদের মালিক পরিবারের কর্তা পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ সরকারি বেতন- ভাতা থেকে কত টাকা উপার্জন করেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ৩৪ বছর সাত মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন- ভাতা বাবদ মোট আয় করেছেন এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা । এর বাইরে পদবি অনুযায়ী পেয়েছেন আনুষঙ্গিক সুযোগ- সুবিধাও। বাংলাদেশ পুলিশের ৩০তম মহাপরিদর্শক ছিলেন বেনজীর আহমেদ। ২০১১, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল( বিপিএম) পেয়েছেন। ২০২১ সালে অবসরে যাওয়ার আগে শুদ্ধাচার পুরস্কারেও ভূষিত হন । ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। এরপরই বেরিয়ে আসে সাবেক এই পুলিশকর্তার থলের বিড়াল ।

সম্পদের মালিকানায় স্ত্রী ও দুই মেয়ে

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুকৌশলী বেনজীর আহমেদ নিজের নামে কোনো সম্পদ করেননি, করেছেন তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে । গোপালগঞ্জে সাভানা ফার্ম প্রডাক্টস, সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা কান্ট্রি ক্লাবসাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেড, সাভানা ইকো রিসোর্ট বানিয়েছেন বেনজীর আহমেদ । বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিতে বড় মেয়ে ফারহিনের নামে ১ লাখ, ছেটে মেয়ে তাহসিনের জন্য আরও এক লাখ শেয়ার কেনা হয়েছে । এম/ এস একটি শিশির বিন্দু( রেজি. পি- ৪৩০৩৬) নামের ফার্মের ৫ শতাংশের মালিকানা বড় মেয়ে । আরও ৫ শতাংশের মালিকানা ছোট মেয়ে । একই প্রতিষ্ঠানে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার ১৫ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে । অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানে ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও মেয়েদের রয়েছে ।

যৌথ মূলধনী ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে একটি নথির সন্ধান পাওয়া গেছে । সেটি বিশ্লেষণ করে দেখাযায়, সাবেক পুলিশ ও র‌্যাব কর্তা বেনজীর আহমেদ তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন সাভানা অ্যাগ্রো । ২০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনধারী সাভানা অ্যাগ্রোর পরিচালক তিনজন । এর চেয়ারম্যান স্ত্রী জীশান মীর্জা । তার নামে রয়েছে ১০টি শেয়ার । এছাড়া সমপরিমাণ শেয়ার নিয়ে ২৯ বছরের বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এমডি । আর ছোট মেয়ে ২৪ বছর বয়সী তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর পরিচালক হিসেবে আছেন । তবে সরেজমিন দেখা গেছে, সাভানা অ্যাগ্রোর ২০ কোটি নয়, এর রয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা ।

বেনজীর আহমেদের পরিবারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান সাভানা ন্যাচারাল পার্ক প্রাইভেট লিমিটেড । রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির( আরজেএসসি) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ৫ কোটি টাকা । সাভানা অ্যাগ্রোর মতোই কোম্পানিটির মালিকানায়ও রয়েছেন তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে । স্ত্রী চেয়ারম্যান এবং এক মেয়ে এমডি, আরেক মেয়ে পরিচালক । তাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে এক লাখ করে মোট ৩ লাখ শেয়ার । সরেজমিন দেখা যায়, সাভানা ন্যাচারাল পার্কের আয়তন প্রায় ছয়শ বিঘা । পার্কটির আকার আরও বাড়াতে ৮০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে । এখন চলছে ভরাটের কাজ ।

যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে পাওয়া নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাভানা অ্যাগ্রোর নিবন্ধনে ঠিকানা হিসেবে দেওয়া হয়েছে২২৮/৩, শেখপাড়া রোড, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা । সরেজমিন দেখা যায়, সাভানা অ্যাগ্রোর ঠিকানাটি বেনজীরের শ্বশুরবাড়ি । তার শ্বশুরের নাম মীর্জা মনসুর উল হক । আর শাশুড়ির নাম লুত্ফুন নেসা মনসুর ।

তথ্যমতে, বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার জন্ম ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই । আর বড় মেয়ের জন্ম ১৯৯৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর । সবছোট মেয়ে জন্ম ২০০০ সালের ১২ এপ্রিলে । দুই মেয়ে মাত্র ২৯ ও ২৪ বছর বয়সেই কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছে । তাও প্রভাবশালী পুলিশকর্তা বাবার অবৈধ আয়ের ওপর ভর করে । যা বলার অপেক্ষা রাখে না । স্ত্রী জীশান মীর্জারও বৈধ আয়ের উৎস না থাকলেও বিপুল বিনিয়োগে গড়ে তোলা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তিনি । জীশান মীর্জার পৈতৃকসূত্রে এতো পরিমাণ সম্পদ পাওয়ার সুযোগ নেই । বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বিয়ে হয় । ছোট মেয়ের এখনো অবিবাহিত । বড় মেয়ের বিয়ের প্রায় একযুগ আগেই বেনজীর কোম্পানিগুলোর জন্য জমি কেনা শুরু করেন এবং মেয়েকে কোম্পানির এমডি বানান ।

সরেজমিনে বেনজীরের রিসোর্ট:

পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদের সম্পদের খোঁজে সরেজমিন অনুসন্ধানে গোপালগঞ্জ যায় সাংবাদিকদের একটি অনুসন্ধানী দল। সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কটিকে স্থানীয়রা ‘বেনজীরের চক’ নামেই চেনে। পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র‌্যাবের ডিজি থাকাকালে তিনি স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে কেনেন প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমি। এসব জমির বিঘাপ্রতি ক্রয়মূল্য ছিলো ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর জমি কেনার পর অন্তত ১৫ ফুট ভরাট করে রিসোর্ট বানিয়েছে। এর কারণ এগুলো বদ্ধ জলাশয় ছিলো। রিসোর্টটি আগে এইট ছিলো মাছের অভয়ারণ্য।

সরেজমিন দেখা যায়, সাভানা রিসোর্টে ১৫টি কটেজ বানানো শেষ। এখন তা পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এর ভাড়া ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা। অঅর রাত হিসাবে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত একই দামে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা দশ থেকে পনের হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। রিসোর্টের দায়িত্বশীলরা জানান, যেকোনো বয়সী ছেলেমেয়ে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই কটেজে থাকতে পারে। চাইলে রাত যাপন করতে পারে।

রিসোর্টটির আলোকসজ্জা করতে মিটার ছাড়াই বিদ্যুতের সরকারি তার সরবরাহ করা হয়েছে খুঁটি ছাড়াই। মাটির ওপর দিয়ে নেওয়া হয়েছে এসব বৈদ্যুতিক তার। যা প্রাণনাশের হুমকিস্বরূপ। এখানে রয়েছে সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিং পুলও। রয়েছে আছে হাজারেরও বেশি ভিয়েতনামি নারকেলগাছ। আরও আছে বিভিন্ন ফলফলাদির গাছ।

এখানেই শেষ নয়, রিসোর্টের নিরাপত্তায় রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। রিসোর্টে প্রবেশ স্বাচ্ছন্দ্য করতে ৭ কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে। যা সম্পূর্ন সরকারি খরচে। রিসোর্টের ভেতরেও সর্বত্র ঢালাইয়ের রাস্তা। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক পিচ ঢালাই করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বেনজীরের নিজ প্রতিষ্ঠানের এসব রাস্তাও করা হয়েছে সরকারি টাকায়।

এ বিষয়ে রিসোর্টের ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান বলেন, বেনজীর আহমেদ রিসোর্টটিকে সাজাচ্ছেন দেশের সবচেয়ে বড় ইকোপার্ক ও বিলাসবহুল রিসোর্টের পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই। এজন্য যা যা দরকার, তা-ই করা হচ্ছে।

বেনজীরের কেনা জমির কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করছেন বেনজীর আহমেদ। ভয়ভীতিতেও কাজ না হলে ভেকু দিয়ে জমির মাটি নিয়ে যেতেন। শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হতো। তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি জমির মালিকরা।

ঢাকা ও পূর্বাচলে বিপুল টাকার সম্পদ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার গুলশানে একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বেনজীর আহমেদের । গুলশান- ১ নম্বরের ১৩০ নম্বর সড়কের এক নম্বর বাড়িটির নাম ‘ র‌্যাংকন আইকন টাওয়ার লেক ভিউ ’ । ভবনের ১২ ও ১৩তম তলায় রয়েছে ৮ হাজার ৬০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট । এর বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা ।

ভবনটি নির্মাণ করে র‌্যাংকন ডেভেলপমেন্টস । প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে১৯.৭৫ কাঠা জমিতে । প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের আয়তন ২ হাজার ১৫০ বর্গফুট । এখানে রয়েছে ১৩টি ফ্লোর এবং দুটি বেইসমেন্ট । সরেজমিনে গেলে ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মো. সবুজ জানান, ১২ ও ১৩তম তলায় রয়েছে বেনজীরের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ।

এ ছাড়াও ঢাকার মগবাজার আদ- দ্বীন হাসপাতাল সংলগ্ন ইস্টার্ন প্রপ্রার্টিজের একটি বহুতল ভবনে ৪ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বেনজীর আহমেদ ।

পূর্বাচলে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি করেছেন বেনজীর আহমেদ । আনন্দ হাউজিং সোসাইটির দক্ষিণ- পশ্চিম এলাকায় পোড়া মোড়ের পাশের এলাকায় অন্তত ৪০ কাঠা জমির ওপর গড়েছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি । এর মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা ।

এলাকার বাসিন্দা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, এই এলাকা ডোবা ও বিল হিসেবে আমরা দেখেছি । কিছুদিন আগেও মাছ ধরেছি । পুলিশের কর্মকর্তারা আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার পরই বেনজীর আহমেদ এই জায়গায় মাটি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন ।

অটোচালক শহিদুল ইসলাম জানান, সোসাইটির ভেতরে সবচেয়ে দামি বাড়ি এটি । আনন্দ হাউজিং এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি । তবে বেনজীরের ডুপ্লেক্স বাড়িটি দেখার জন্য ভিড় জমায় মানুষ ।

ঢাকার পূর্বাচলের ফারুক মার্কেটের পেছনের দিকে ১৭ নম্বর সেক্টরের ৩০১ নম্বর রোডের জি ব্লকে ১০ নম্বর প্লটের মালিক পুলিশের সাবেক এই আইজি । স্থানীয়রা বলছেন, ১০ কাঠা পরিমাণের এই প্লটের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২২ কোটি টাকা । বেনজীর আহমেদ পুলিশের আইজি থাকাকালে এই প্লট কেনেন । জানা যায়, পুলিশের এই সাবেক আইজি তার ১০ কাঠার প্লটটি বিক্রির পরিকল্পনা করছেন । এরমধ্যে বেশ কিছু ক্রেতার সাথে আলোচনা চলছে । ওই এলাকার আব্দুল কাদের, মোহাম্মদ নাঈমও মোহাম্মদ মোহসিন নামের ৩ ব্যক্তি পুলিশের সাবেক এই আইজির ১০ কাঠার প্লটটির বিষয়ে আলাপকালে এই তথ্য নিশ্চিত করেন ।

এছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নাওড়ায় রয়েছে বেনজীর আহমেদের দুই বিঘা জমি, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা ।

বেনজীরের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, আইন সবার জন্য সমান । কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে ।

বেনজীর আহমেদ পুলিশের একজন প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, এ ক্ষেত্রে দুদক কতটুকু কী করতে পারবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইনে প্রভাবশালী নিয়ে কিছু বলা নেই । সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীরও দুর্নীতির বিচার হয়েছে । সুতরাং যে কারো দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চাইলে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে ।

দুদক কমিশনার( তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট তথ্য- প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই অনুসন্ধান করা হবে । তবে এখানে বলে রাখা ভালো, কারো বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে পর্যাপ্ত ‘ সাপোর্টিং পেপারস ’ আমাদের কাছে থাকতে হয় ।

তিনি আরও বলেন, সুনির্দিষ্ট ও সঠিক তথ্য পেলে দুদক বেনজীর কেন, যে কারো বিরুদ্ধেই অনুসন্ধান করবে । আর সুনির্দিষ্ট তথ্য- প্রমাণ পাওয়ার পরও যদি অনুসন্ধান না করা হয়, তাহলে দুদকের বিরুদ্ধেই তো রিপোর্ট হবে ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয় । তিনি রিসিভ করেননি । পরবর্তীতে খুদে বার্তা পাঠিয়ে বক্তব্য প্রয়োজন বলে জানানো হলেও তিনি সাড়া দেননি ।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

আলাদীনের চেরাগ বেনজীরের ঘরে

সংবাদ প্রকাশের সময় : ০২:৪৪:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ মার্চ ২০২৪

ঢাকা- মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ফরিদপুরের ভাঙ্গা চৌরাস্তা থেকে টেকেরহাট হয়ে সামনে গেলেই গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রাম। নিভৃত এই পল্লীর মাঝে গড়ে উঠেছে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামে এক অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র। এখানে একরাত থাকতে গেলে গুনতে হবে ১৫ হাজার টাকা । সাভানা ইকো রিসোর্ট ঘুরে দেখা গেছে একই সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর হাতে গড়া আভিজাত্যের অপরূপ মিশেল । বিশাল আকৃতির ১৫টি পুকুরের চারপাশে গার্ড ওয়াল, পানির কৃত্রিম ঝরনা, দৃষ্টিনন্দন ঘাট ও আলোর ঝলকানি ।

পার ঘেঁষে রয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কটেজ । বিদেশি শিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি স্থাপত্য নকশা তাতে শোভা পাচ্ছে । কটেজের ভেতর থেকে পুকুর পর্যন্ত যেতে মাটিতে পা ফেলাতে হবে না। সরাসরি কটেজ থেকে কাচে ঘেরা আবরণ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় শান-বাঁধানো ঘাটে । সাভানা ইকো রিসোর্টের পরিধি এতটাই বড়- সাহাপুর গ্রামের নাম লিখে গুগলে সার্চ দিলে এই রিসোর্টটিই আগে ভেসে ওঠে পর্দায় ।

এক হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত সাভানা ইকো রিসোর্টের বিভিন্ন জায়গায় বানানো হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়। রয়েছে সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিং পুলও। আছে ভিয়েতনামি নারকেলগাছসহ বিভিন্ন ফলফলাদির গাছ । রয়েছে উন্নতমানের সাউন্ড সিস্টেম ও বিশাল আকৃতির কনসার্ট হল ।

দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একক পরিবারের জন্য বানানো এসব কটেজের পেছনে ব্যয় হয়েছে অর্ধকোটি টাকারও বেশি । যুগলদের কাছে কটেজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রিসোর্টের ভেতরে এখন আরও ৫০টি কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে । রিসোর্টের নিরাপত্তায় পাশেই ‘ বিশেষ ’ পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়েছে। সরকারি খরচে যাতায়াতের জন্য বানানো হয়েছে ৫ কিলোমিটারের বেশি পাকা সড়ক ।

দেশে নজিরবিহীন এ রকম আভিজাত্যে ঘেরা পর্যটন স্পটটির মালিকদের নাম শুনলে অঅতকে উঠবেন না। রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ( আইজিপি) ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবার এর মালিক ।

সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক( এমডি) বেনজীরের বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এবং পরিচালক ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ।

শুধু এই এক ইকো রিসোর্টই নয়, পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড় । অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের নামে অন্তত ছয়টি কম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে । এর পাঁচটিই নিজ জেলা গোপালগঞ্জে । জেলা সদরের সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা পাওয়া গেছে ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে বেনজীর আহমেদের রয়েছে অঢেল সম্পদ । রয়েছে দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার কাছেই দামি এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি । দুই মেয়ের নামে রয়েছে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের দুই লাখ শেয়ার । পূর্বাচলে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার বাজার মূল্য কম হলেও ৪৫ কোটি টাকা । একই এলাকায় রয়েছে ২২ কোটি টাকা দামের ১০ বিঘা জমি রয়েছে ।

এই বিপুল সম্পদের মালিক পরিবারের কর্তা পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ সরকারি বেতন- ভাতা থেকে কত টাকা উপার্জন করেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ৩৪ বছর সাত মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন- ভাতা বাবদ মোট আয় করেছেন এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা । এর বাইরে পদবি অনুযায়ী পেয়েছেন আনুষঙ্গিক সুযোগ- সুবিধাও। বাংলাদেশ পুলিশের ৩০তম মহাপরিদর্শক ছিলেন বেনজীর আহমেদ। ২০১১, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল( বিপিএম) পেয়েছেন। ২০২১ সালে অবসরে যাওয়ার আগে শুদ্ধাচার পুরস্কারেও ভূষিত হন । ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। এরপরই বেরিয়ে আসে সাবেক এই পুলিশকর্তার থলের বিড়াল ।

সম্পদের মালিকানায় স্ত্রী ও দুই মেয়ে

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুকৌশলী বেনজীর আহমেদ নিজের নামে কোনো সম্পদ করেননি, করেছেন তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে । গোপালগঞ্জে সাভানা ফার্ম প্রডাক্টস, সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা কান্ট্রি ক্লাবসাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেড, সাভানা ইকো রিসোর্ট বানিয়েছেন বেনজীর আহমেদ । বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিতে বড় মেয়ে ফারহিনের নামে ১ লাখ, ছেটে মেয়ে তাহসিনের জন্য আরও এক লাখ শেয়ার কেনা হয়েছে । এম/ এস একটি শিশির বিন্দু( রেজি. পি- ৪৩০৩৬) নামের ফার্মের ৫ শতাংশের মালিকানা বড় মেয়ে । আরও ৫ শতাংশের মালিকানা ছোট মেয়ে । একই প্রতিষ্ঠানে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার ১৫ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে । অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানে ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও মেয়েদের রয়েছে ।

যৌথ মূলধনী ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে একটি নথির সন্ধান পাওয়া গেছে । সেটি বিশ্লেষণ করে দেখাযায়, সাবেক পুলিশ ও র‌্যাব কর্তা বেনজীর আহমেদ তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন সাভানা অ্যাগ্রো । ২০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনধারী সাভানা অ্যাগ্রোর পরিচালক তিনজন । এর চেয়ারম্যান স্ত্রী জীশান মীর্জা । তার নামে রয়েছে ১০টি শেয়ার । এছাড়া সমপরিমাণ শেয়ার নিয়ে ২৯ বছরের বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এমডি । আর ছোট মেয়ে ২৪ বছর বয়সী তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর পরিচালক হিসেবে আছেন । তবে সরেজমিন দেখা গেছে, সাভানা অ্যাগ্রোর ২০ কোটি নয়, এর রয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা ।

বেনজীর আহমেদের পরিবারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান সাভানা ন্যাচারাল পার্ক প্রাইভেট লিমিটেড । রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির( আরজেএসসি) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ৫ কোটি টাকা । সাভানা অ্যাগ্রোর মতোই কোম্পানিটির মালিকানায়ও রয়েছেন তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে । স্ত্রী চেয়ারম্যান এবং এক মেয়ে এমডি, আরেক মেয়ে পরিচালক । তাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে এক লাখ করে মোট ৩ লাখ শেয়ার । সরেজমিন দেখা যায়, সাভানা ন্যাচারাল পার্কের আয়তন প্রায় ছয়শ বিঘা । পার্কটির আকার আরও বাড়াতে ৮০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে । এখন চলছে ভরাটের কাজ ।

যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে পাওয়া নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাভানা অ্যাগ্রোর নিবন্ধনে ঠিকানা হিসেবে দেওয়া হয়েছে২২৮/৩, শেখপাড়া রোড, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা । সরেজমিন দেখা যায়, সাভানা অ্যাগ্রোর ঠিকানাটি বেনজীরের শ্বশুরবাড়ি । তার শ্বশুরের নাম মীর্জা মনসুর উল হক । আর শাশুড়ির নাম লুত্ফুন নেসা মনসুর ।

তথ্যমতে, বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার জন্ম ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই । আর বড় মেয়ের জন্ম ১৯৯৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর । সবছোট মেয়ে জন্ম ২০০০ সালের ১২ এপ্রিলে । দুই মেয়ে মাত্র ২৯ ও ২৪ বছর বয়সেই কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছে । তাও প্রভাবশালী পুলিশকর্তা বাবার অবৈধ আয়ের ওপর ভর করে । যা বলার অপেক্ষা রাখে না । স্ত্রী জীশান মীর্জারও বৈধ আয়ের উৎস না থাকলেও বিপুল বিনিয়োগে গড়ে তোলা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তিনি । জীশান মীর্জার পৈতৃকসূত্রে এতো পরিমাণ সম্পদ পাওয়ার সুযোগ নেই । বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বিয়ে হয় । ছোট মেয়ের এখনো অবিবাহিত । বড় মেয়ের বিয়ের প্রায় একযুগ আগেই বেনজীর কোম্পানিগুলোর জন্য জমি কেনা শুরু করেন এবং মেয়েকে কোম্পানির এমডি বানান ।

সরেজমিনে বেনজীরের রিসোর্ট:

পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদের সম্পদের খোঁজে সরেজমিন অনুসন্ধানে গোপালগঞ্জ যায় সাংবাদিকদের একটি অনুসন্ধানী দল। সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কটিকে স্থানীয়রা ‘বেনজীরের চক’ নামেই চেনে। পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র‌্যাবের ডিজি থাকাকালে তিনি স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে কেনেন প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমি। এসব জমির বিঘাপ্রতি ক্রয়মূল্য ছিলো ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর জমি কেনার পর অন্তত ১৫ ফুট ভরাট করে রিসোর্ট বানিয়েছে। এর কারণ এগুলো বদ্ধ জলাশয় ছিলো। রিসোর্টটি আগে এইট ছিলো মাছের অভয়ারণ্য।

সরেজমিন দেখা যায়, সাভানা রিসোর্টে ১৫টি কটেজ বানানো শেষ। এখন তা পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এর ভাড়া ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা। অঅর রাত হিসাবে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত একই দামে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা দশ থেকে পনের হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। রিসোর্টের দায়িত্বশীলরা জানান, যেকোনো বয়সী ছেলেমেয়ে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই কটেজে থাকতে পারে। চাইলে রাত যাপন করতে পারে।

রিসোর্টটির আলোকসজ্জা করতে মিটার ছাড়াই বিদ্যুতের সরকারি তার সরবরাহ করা হয়েছে খুঁটি ছাড়াই। মাটির ওপর দিয়ে নেওয়া হয়েছে এসব বৈদ্যুতিক তার। যা প্রাণনাশের হুমকিস্বরূপ। এখানে রয়েছে সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিং পুলও। রয়েছে আছে হাজারেরও বেশি ভিয়েতনামি নারকেলগাছ। আরও আছে বিভিন্ন ফলফলাদির গাছ।

এখানেই শেষ নয়, রিসোর্টের নিরাপত্তায় রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। রিসোর্টে প্রবেশ স্বাচ্ছন্দ্য করতে ৭ কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে। যা সম্পূর্ন সরকারি খরচে। রিসোর্টের ভেতরেও সর্বত্র ঢালাইয়ের রাস্তা। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক পিচ ঢালাই করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বেনজীরের নিজ প্রতিষ্ঠানের এসব রাস্তাও করা হয়েছে সরকারি টাকায়।

এ বিষয়ে রিসোর্টের ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান বলেন, বেনজীর আহমেদ রিসোর্টটিকে সাজাচ্ছেন দেশের সবচেয়ে বড় ইকোপার্ক ও বিলাসবহুল রিসোর্টের পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই। এজন্য যা যা দরকার, তা-ই করা হচ্ছে।

বেনজীরের কেনা জমির কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করছেন বেনজীর আহমেদ। ভয়ভীতিতেও কাজ না হলে ভেকু দিয়ে জমির মাটি নিয়ে যেতেন। শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হতো। তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি জমির মালিকরা।

ঢাকা ও পূর্বাচলে বিপুল টাকার সম্পদ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার গুলশানে একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বেনজীর আহমেদের । গুলশান- ১ নম্বরের ১৩০ নম্বর সড়কের এক নম্বর বাড়িটির নাম ‘ র‌্যাংকন আইকন টাওয়ার লেক ভিউ ’ । ভবনের ১২ ও ১৩তম তলায় রয়েছে ৮ হাজার ৬০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট । এর বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা ।

ভবনটি নির্মাণ করে র‌্যাংকন ডেভেলপমেন্টস । প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে১৯.৭৫ কাঠা জমিতে । প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের আয়তন ২ হাজার ১৫০ বর্গফুট । এখানে রয়েছে ১৩টি ফ্লোর এবং দুটি বেইসমেন্ট । সরেজমিনে গেলে ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মো. সবুজ জানান, ১২ ও ১৩তম তলায় রয়েছে বেনজীরের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ।

এ ছাড়াও ঢাকার মগবাজার আদ- দ্বীন হাসপাতাল সংলগ্ন ইস্টার্ন প্রপ্রার্টিজের একটি বহুতল ভবনে ৪ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বেনজীর আহমেদ ।

পূর্বাচলে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি করেছেন বেনজীর আহমেদ । আনন্দ হাউজিং সোসাইটির দক্ষিণ- পশ্চিম এলাকায় পোড়া মোড়ের পাশের এলাকায় অন্তত ৪০ কাঠা জমির ওপর গড়েছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি । এর মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা ।

এলাকার বাসিন্দা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, এই এলাকা ডোবা ও বিল হিসেবে আমরা দেখেছি । কিছুদিন আগেও মাছ ধরেছি । পুলিশের কর্মকর্তারা আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার পরই বেনজীর আহমেদ এই জায়গায় মাটি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন ।

অটোচালক শহিদুল ইসলাম জানান, সোসাইটির ভেতরে সবচেয়ে দামি বাড়ি এটি । আনন্দ হাউজিং এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি । তবে বেনজীরের ডুপ্লেক্স বাড়িটি দেখার জন্য ভিড় জমায় মানুষ ।

ঢাকার পূর্বাচলের ফারুক মার্কেটের পেছনের দিকে ১৭ নম্বর সেক্টরের ৩০১ নম্বর রোডের জি ব্লকে ১০ নম্বর প্লটের মালিক পুলিশের সাবেক এই আইজি । স্থানীয়রা বলছেন, ১০ কাঠা পরিমাণের এই প্লটের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২২ কোটি টাকা । বেনজীর আহমেদ পুলিশের আইজি থাকাকালে এই প্লট কেনেন । জানা যায়, পুলিশের এই সাবেক আইজি তার ১০ কাঠার প্লটটি বিক্রির পরিকল্পনা করছেন । এরমধ্যে বেশ কিছু ক্রেতার সাথে আলোচনা চলছে । ওই এলাকার আব্দুল কাদের, মোহাম্মদ নাঈমও মোহাম্মদ মোহসিন নামের ৩ ব্যক্তি পুলিশের সাবেক এই আইজির ১০ কাঠার প্লটটির বিষয়ে আলাপকালে এই তথ্য নিশ্চিত করেন ।

এছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নাওড়ায় রয়েছে বেনজীর আহমেদের দুই বিঘা জমি, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা ।

বেনজীরের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, আইন সবার জন্য সমান । কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে ।

বেনজীর আহমেদ পুলিশের একজন প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, এ ক্ষেত্রে দুদক কতটুকু কী করতে পারবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইনে প্রভাবশালী নিয়ে কিছু বলা নেই । সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীরও দুর্নীতির বিচার হয়েছে । সুতরাং যে কারো দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চাইলে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে ।

দুদক কমিশনার( তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট তথ্য- প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই অনুসন্ধান করা হবে । তবে এখানে বলে রাখা ভালো, কারো বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে পর্যাপ্ত ‘ সাপোর্টিং পেপারস ’ আমাদের কাছে থাকতে হয় ।

তিনি আরও বলেন, সুনির্দিষ্ট ও সঠিক তথ্য পেলে দুদক বেনজীর কেন, যে কারো বিরুদ্ধেই অনুসন্ধান করবে । আর সুনির্দিষ্ট তথ্য- প্রমাণ পাওয়ার পরও যদি অনুসন্ধান না করা হয়, তাহলে দুদকের বিরুদ্ধেই তো রিপোর্ট হবে ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয় । তিনি রিসিভ করেননি । পরবর্তীতে খুদে বার্তা পাঠিয়ে বক্তব্য প্রয়োজন বলে জানানো হলেও তিনি সাড়া দেননি ।