ঢাকা ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুদকের জালে দাদা এমদাদ

বিশেষ প্রতিবেদক
  • সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:৪১:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ১৬৪ বার পড়া হয়েছে
বাংলা টাইমস অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

এমদাদুল হক ওরফে দাদা এমদাদ। সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সহকারী একান্ত সচিব( এপিএস) । ক্ষমতার জোরে হাতে পেয়েছেন রূপকথার আশ্চর্য প্রদীপ। আর এই আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় রাজধানী, পাশের রূপগঞ্জ এবং জন্মস্থান সিরাজগঞ্জে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড় । অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক যুগের বেশি সময় ধরে সাবেক মন্ত্রীর এপিএসের চাকরিতে থাকাকালে এসব সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি । শুধু সিরাজগঞ্জেই তার প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে । নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও রয়েছে তার বিপুল সম্পদ ।

ড্রেজার ব্যবসার পাশাপাশি তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে আবাসন খাতেও । জমি দখল, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে রূপগঞ্জের মাদক সাম্রাজ্যও নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি । এসব খাত থেকে অর্জিত অবৈধ অর্থে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন দাদা এমদাদ ।

তবে দাদা এমদাদের এসব অবৈধ সম্পদ এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের ( দুদক) জালে । এরইমধ্যে তার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে সংস্থাটি । তাকে তলব করে চিঠিও দিয়েছে দুদক । তবে সুকৌশলে কালক্ষেপণ করছেন এমদাদ। দুদক সূত্রমতে, অর্জিত সম্পদের তথ্য চেয়ে তাকে যে চিঠি দিয়েছে দুদক, তার উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি ।

রূপগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর চেয়েও ক্ষমতাবান তাঁর এপিএস এমদাদ । তাঁকে টাকা না দিলে রূপগঞ্জে নিরাপদে চলা যায় না । চাঁদা না দিলে গাড়ি চলে না, ঘোরে না কারখানার চাকা । আর চাঁদা দিলে দোকান খুলে নির্বিঘ্নে মাদকও বিক্রি করা যায় ।

স্থানীয়রা জানায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বালু ব্যবসা থেকে শুরু করে মাদক বাণিজ্য এমদাদের নিয়ন্ত্রণে । ফেসবুকে রয়েছে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার ছবি। সন্ত্রাসীরাও তাদের ক্ষমতা দেখাতে প্রভাবশালী এমদাদের সাথে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় ।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সহকারী একান্ত সচিবদের( এপিএস) সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদা প্রদান করা হয় । পাশাপাশি ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হয় । ষষ্ঠ গ্রেড অনুযায়ী একজন এপিএস সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬৭ হাজার ১০ টাকা বেতন গ্রহণ করতে পারেন । বেতনের সর্বোচ্চ অঙ্কটি ধরলেও বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সহকারী একান্ত সচিব( এপিএস) হিসেবে এমদাদুল হক দায়িত্বকালীন ১৩ বছরে পেয়েছেন এক কোটি টাকার কিছু বেশি । কিন্তু এই সামান্য বেতনের আড়ালে এমদাদ গড়ে তুলেছেন বিপুল অবৈধ সম্পদ ।

সিরাজগঞ্জে শতকোটি টাকার সম্পদ : সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌরসভার দরগাহপাড়া গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে এমদাদুল হক কয়েক বছর আগে ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ । এখন এলাকায় তার রমরমা অবস্থা । এলাকাবাসীর কণ্ঠে শোনা গেলো তার দিনবদলের রূপকথার গল্প । নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এলাকাবাসী বলেন, এমদাদ এখন লাখ টাকার হিসাব করেন না, কোটি টাকার হিসাব করেন । মন্ত্রীর এপিএস হওয়ার পর অনেক জমি কিনেছেন ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজ জন্মস্থান শাহজাদপুরে প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন এমদাদ । শাহজাদপুরের দরগাহপাড়ার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ জমি । বর্তমানে এসব জমির মূল্য প্রতি শতক অন্তত ২৫ লাখ টাকা । সেই হিসাবে এখানে তাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা । শহরের প্রাণকেন্দ্র পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে মণিরামপুর বাজারে ৭ শতাংশ জমির ওপর রয়েছে ১৪টি দোকান, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ টাকা । এর পাশেই অন্তত দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৪ শতাংশ জমির ওপর ভবন রয়েছে ।

শুধু তা- ই নয়, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দরিয়াপুরে ১৪ শতাংশ জমি রয়েছে । বর্তমানে এখানে প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ লাখ টাকা ।

ঢাকায় যত সম্পদ এমদাদের অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর আবাসিক এলাকায় যায় আমাদের অনুসন্ধানী দল । জানা গেছে, রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী জামে মসজিদ লাগোয়া উঁচু দেয়াল ঘেরা ভবনটি এমদাদুল হকের । একই এলাকার কে ব্লকের ১৩/৩ নম্বর রোডের ৩০/ বি- ৩০/ সি বাড়িটিও তার । ভবনটির দায়িত্বে এমদাদুল হকের গাড়িচালক রাজ্জাক ।

পরিচয় গোপন করে কথা হয় এমদাদের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সাইফুলের সঙ্গে । সাইফুলের কাছ থেকে পাওয়া গেল এমদাদের বেশ কয়েকটি বাড়ির খোঁজ । আলাপে সাইফুল জানান, দক্ষিণ বনশ্রীর বাড়ি ছাড়াও বাসাবোতে রয়েছে আরো দুটি বাড়ি । এর মধ্যে একটি বাড়ি ১০ তলা । অন্যটি ছয়তলা ।

সাইফুলের কথার সূত্র ধরে এমদাদের বাড়ির খোঁজে বাসাবো এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ৩৬ নম্বর উত্তর বাসাবোর বেস্ট লিভিং লিমিটেডের বেস্ট বেয়ারেক লিভিং অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন এই এমদাদ । সেখানে ছদ্মবেশে গিয়ে কথা হয় অ্যাপার্টমেন্টটির নিরাপত্তা প্রহরীর সাথে।

তিনি জানান, ওই অ্যাপার্টমেন্টে এমদাদের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে । তিনি পঞ্চম তলায় থাকেন । স্থানীয়রা জানায়, বেস্ট বেয়ারেক লিভিং অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা । এই ভবনেই পাওয়া গেছে এমদাদুল হকের সরকারি স্টিকারযুক্ত গাড়ি ।

সূত্র বলছে, আবাসন ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেছেন এমদাদ । রিমঝিম আবাসনের ১৫ শতাংশ শেয়ার এমদাদের নামে । এ ছাড়া রূপগঞ্জের বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প থেকে নামে- বেনামে প্লট বুঝে নেন তিনি ।

অবৈধ গ্যাসলাইনের সংযোগ নিয়ন্ত্রণে এমদাদ: রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নিম্নমানের পাইপ টেনে সেখান অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন এমদাদ । এই সংযোগ দিতে এমদাদ তিতাসের কর্মকর্তা- কর্মচারীসহ এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট । এসব অবৈধ সংযোগের ফলে কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার ।

সূত্র বলছে, রূপগঞ্জে এমদাদের ব্যবস্থাপনায় প্রায় দেড় লাখ আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে । এর মধ্যে তারাব বেড়িবাঁধ, মোগরাকুল, বরাব, খাদুন, মৈকুলী, খিদিরপুর, নয়াপাড়া, বড়ভিটা, আরাফাতনগরসহ ঢাকা- সিলেট মহাসড়কের আশপাশের বেশির ভাগ ভবন ও কারখানায় সংযোগ দেওয়া হয়েছে ।

স্থানীয় লোকজন জানায়, প্রতিটি আবাসিক সংযোগে এককালীন দিতে হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা । সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে আবারও টাকা দিলে পুনরায় সংযোগ দেয়া হয় । তবে আবাসিক সংযোগে গ্যাসের চাপ বুঝে সর্বনিম্ন ২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকাও দিতে হয় ।

তারাব পৌরসভার বাসিন্দা হাসানুর রহমান বলেন, ‘ স্থানীয় প্রশাসন ও তিতাসের সমন্বয়ে কয়েক মাস পর পর অভিযান পরিচালনা করা হয়, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় । প্রশাসন চলে যাওয়ার পর পুনরায় অবৈধ সংযোগ দিয়ে যায় । স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা না থাকলে অবৈধ সংযোগ প্রদান সম্ভব হতো না । ’

ড্রেজার ও বালু ব্যবসায় এমদাদের হাত: সাবেক মন্ত্রীর এপিএস হওয়ার পর ধীরে ধীরে রূপগঞ্জের ড্রেজার ও বালুর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন এমদাদ। রূপগঞ্জে দুটি ড্রেজার থেকে ভোলাব, কুতুবপুর, মোচারতালুক মৌজায় রিমঝিম আবাসনে বালু ভরাটের কাজ চলছে। এমদাদের দাপটের কারণে হাইকোর্টে রিট করেও বালু ভরাট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর আগে সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ড্রেজারে আগুন লাগিয়ে দেয়। সংবাদ চর্চার সম্পাদক মুন্না খান এবং রূপগঞ্জ উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোমেন ও সাধারণ সম্পাদক মকবুল হোসেনের নামে এমদাদের ড্রেজার চলছে এশিয়ান ডুপ্লেক্স টাউনে। কাঞ্চন পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুন্নাহারের নামে এমদাদের ড্রেজার চলছে আমেরিকান সিটিতে। এ ছাড়া ইস্টউড সিটিতে এমদাদের একটি ড্রেজার চলছে। এ ছাড়া রূপগঞ্জের যত ড্রেজার রয়েছে তা থেকে উত্তোলিত বালুর দামের ৫ শতাংশ এমদাদকে দিতে হয় বলে জানা গেছে।

মাদক বাণিজ্য থেকে মাসে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আয়: অভিযোগে বলা হয়, রূপগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন এমদাদ। ভোলাব ইউনিয়নের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন যুবলীগ সভাপতি কাউসার প্রধান, কাঞ্চনে বাছির ও শাহিন মিয়া (লোহা শাহিন)। দাউদপুর, রূপগঞ্জ ইউনিয়ন ও কায়েতপাড়ার চনপাড়ায় শমসের আলী ওরফে ডাকু শমসের, তারাব, গোলাকান্দাইল, ভুলতা, মুড়াপাড়ায়ও রয়েছে এমদাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক। এসব মাদক কারবারির কাছ থেকে মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা চাঁদা তোলেন এমদাদ।

সড়ক ও পরিবহনে চাঁদাবাজি: ভুলতা গাউসিয়ার ফুটপাতে চার শতাধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকানের প্রতিটি থেকে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা তোলেন এমদাদের নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ-যুবলীগের সদস্যরা। চাঁদা না দিলে পিটিয়ে এলাকাছাড়া করা হয়। এ ছাড়া রূপগঞ্জের সব বাজার থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে এমদাদের সন্ত্রাসীরা। এর বড় অংশ যায় এমদাদের পকেটে। এ ছাড়া সিলেট, গাজীপুর, মদনপুর ও ঢাকার সংযোগ সড়কের বিভিন্ন স্ট্যান্ডের পরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে এমদাদের বাহিনী। প্রতিদিন গাড়িপ্রতি সর্বনিম্ন ৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় চালকদের। রূপগঞ্জ স্ট্যান্ডে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা এবং ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার রয়েছে যথাক্রমে প্রায় ২৭০টি, ২৫০টি ও ৮০টি। এর মধ্যে প্রতিটি অটোরিকশা থেকে দৈনিক ৫০ টাকা, লেগুনা থেকে ৬০ টাকা, প্রাইভেট কার থেকে ১০০ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া মাসিক এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা এককালীন চাঁদাও দিতে হয়।

সীমানা পিলার সরিয়ে নদী দখল: শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানা পিলার সরিয়ে এমদাদের ছত্রচ্ছায়ায় নদীর জমি দখল করছে সন্ত্রাসীরা। গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক সেতুর দুই পাশের নদীর তীর দখল করে নিচ্ছে এমদাদ ও তার বাহিনী। রূপগঞ্জের মঠের ঘাট, বানিয়াদি, দড়িকান্দি, আতলাশপুর, হাটাব জেলেপাড়া, পাড়াগাঁও, ইছাখালী, বড় আলু, রূপসী, পূর্বগ্রাম, চনপাড়া, গন্ধবপুরের নদীর দুই পাশের জমি দখল করে বিভিন্ন কম্পানির কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। জমিগুলো আফজাল ফুড, এনডিই রেডিমিক্স, কেপিসি ও রংধনু গ্রুপের দখলে আছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

দুদকের জালে দাদা এমদাদ

সংবাদ প্রকাশের সময় : ১২:৪১:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

এমদাদুল হক ওরফে দাদা এমদাদ। সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সহকারী একান্ত সচিব( এপিএস) । ক্ষমতার জোরে হাতে পেয়েছেন রূপকথার আশ্চর্য প্রদীপ। আর এই আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় রাজধানী, পাশের রূপগঞ্জ এবং জন্মস্থান সিরাজগঞ্জে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড় । অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক যুগের বেশি সময় ধরে সাবেক মন্ত্রীর এপিএসের চাকরিতে থাকাকালে এসব সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি । শুধু সিরাজগঞ্জেই তার প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে । নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও রয়েছে তার বিপুল সম্পদ ।

ড্রেজার ব্যবসার পাশাপাশি তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে আবাসন খাতেও । জমি দখল, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে রূপগঞ্জের মাদক সাম্রাজ্যও নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি । এসব খাত থেকে অর্জিত অবৈধ অর্থে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন দাদা এমদাদ ।

তবে দাদা এমদাদের এসব অবৈধ সম্পদ এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের ( দুদক) জালে । এরইমধ্যে তার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে সংস্থাটি । তাকে তলব করে চিঠিও দিয়েছে দুদক । তবে সুকৌশলে কালক্ষেপণ করছেন এমদাদ। দুদক সূত্রমতে, অর্জিত সম্পদের তথ্য চেয়ে তাকে যে চিঠি দিয়েছে দুদক, তার উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি ।

রূপগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর চেয়েও ক্ষমতাবান তাঁর এপিএস এমদাদ । তাঁকে টাকা না দিলে রূপগঞ্জে নিরাপদে চলা যায় না । চাঁদা না দিলে গাড়ি চলে না, ঘোরে না কারখানার চাকা । আর চাঁদা দিলে দোকান খুলে নির্বিঘ্নে মাদকও বিক্রি করা যায় ।

স্থানীয়রা জানায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বালু ব্যবসা থেকে শুরু করে মাদক বাণিজ্য এমদাদের নিয়ন্ত্রণে । ফেসবুকে রয়েছে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার ছবি। সন্ত্রাসীরাও তাদের ক্ষমতা দেখাতে প্রভাবশালী এমদাদের সাথে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় ।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সহকারী একান্ত সচিবদের( এপিএস) সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদা প্রদান করা হয় । পাশাপাশি ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হয় । ষষ্ঠ গ্রেড অনুযায়ী একজন এপিএস সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬৭ হাজার ১০ টাকা বেতন গ্রহণ করতে পারেন । বেতনের সর্বোচ্চ অঙ্কটি ধরলেও বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সহকারী একান্ত সচিব( এপিএস) হিসেবে এমদাদুল হক দায়িত্বকালীন ১৩ বছরে পেয়েছেন এক কোটি টাকার কিছু বেশি । কিন্তু এই সামান্য বেতনের আড়ালে এমদাদ গড়ে তুলেছেন বিপুল অবৈধ সম্পদ ।

সিরাজগঞ্জে শতকোটি টাকার সম্পদ : সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌরসভার দরগাহপাড়া গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে এমদাদুল হক কয়েক বছর আগে ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ । এখন এলাকায় তার রমরমা অবস্থা । এলাকাবাসীর কণ্ঠে শোনা গেলো তার দিনবদলের রূপকথার গল্প । নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এলাকাবাসী বলেন, এমদাদ এখন লাখ টাকার হিসাব করেন না, কোটি টাকার হিসাব করেন । মন্ত্রীর এপিএস হওয়ার পর অনেক জমি কিনেছেন ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজ জন্মস্থান শাহজাদপুরে প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন এমদাদ । শাহজাদপুরের দরগাহপাড়ার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ জমি । বর্তমানে এসব জমির মূল্য প্রতি শতক অন্তত ২৫ লাখ টাকা । সেই হিসাবে এখানে তাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা । শহরের প্রাণকেন্দ্র পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে মণিরামপুর বাজারে ৭ শতাংশ জমির ওপর রয়েছে ১৪টি দোকান, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ টাকা । এর পাশেই অন্তত দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৪ শতাংশ জমির ওপর ভবন রয়েছে ।

শুধু তা- ই নয়, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দরিয়াপুরে ১৪ শতাংশ জমি রয়েছে । বর্তমানে এখানে প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ লাখ টাকা ।

ঢাকায় যত সম্পদ এমদাদের অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর আবাসিক এলাকায় যায় আমাদের অনুসন্ধানী দল । জানা গেছে, রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী জামে মসজিদ লাগোয়া উঁচু দেয়াল ঘেরা ভবনটি এমদাদুল হকের । একই এলাকার কে ব্লকের ১৩/৩ নম্বর রোডের ৩০/ বি- ৩০/ সি বাড়িটিও তার । ভবনটির দায়িত্বে এমদাদুল হকের গাড়িচালক রাজ্জাক ।

পরিচয় গোপন করে কথা হয় এমদাদের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সাইফুলের সঙ্গে । সাইফুলের কাছ থেকে পাওয়া গেল এমদাদের বেশ কয়েকটি বাড়ির খোঁজ । আলাপে সাইফুল জানান, দক্ষিণ বনশ্রীর বাড়ি ছাড়াও বাসাবোতে রয়েছে আরো দুটি বাড়ি । এর মধ্যে একটি বাড়ি ১০ তলা । অন্যটি ছয়তলা ।

সাইফুলের কথার সূত্র ধরে এমদাদের বাড়ির খোঁজে বাসাবো এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ৩৬ নম্বর উত্তর বাসাবোর বেস্ট লিভিং লিমিটেডের বেস্ট বেয়ারেক লিভিং অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন এই এমদাদ । সেখানে ছদ্মবেশে গিয়ে কথা হয় অ্যাপার্টমেন্টটির নিরাপত্তা প্রহরীর সাথে।

তিনি জানান, ওই অ্যাপার্টমেন্টে এমদাদের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে । তিনি পঞ্চম তলায় থাকেন । স্থানীয়রা জানায়, বেস্ট বেয়ারেক লিভিং অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা । এই ভবনেই পাওয়া গেছে এমদাদুল হকের সরকারি স্টিকারযুক্ত গাড়ি ।

সূত্র বলছে, আবাসন ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেছেন এমদাদ । রিমঝিম আবাসনের ১৫ শতাংশ শেয়ার এমদাদের নামে । এ ছাড়া রূপগঞ্জের বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প থেকে নামে- বেনামে প্লট বুঝে নেন তিনি ।

অবৈধ গ্যাসলাইনের সংযোগ নিয়ন্ত্রণে এমদাদ: রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নিম্নমানের পাইপ টেনে সেখান অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন এমদাদ । এই সংযোগ দিতে এমদাদ তিতাসের কর্মকর্তা- কর্মচারীসহ এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট । এসব অবৈধ সংযোগের ফলে কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার ।

সূত্র বলছে, রূপগঞ্জে এমদাদের ব্যবস্থাপনায় প্রায় দেড় লাখ আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে । এর মধ্যে তারাব বেড়িবাঁধ, মোগরাকুল, বরাব, খাদুন, মৈকুলী, খিদিরপুর, নয়াপাড়া, বড়ভিটা, আরাফাতনগরসহ ঢাকা- সিলেট মহাসড়কের আশপাশের বেশির ভাগ ভবন ও কারখানায় সংযোগ দেওয়া হয়েছে ।

স্থানীয় লোকজন জানায়, প্রতিটি আবাসিক সংযোগে এককালীন দিতে হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা । সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে আবারও টাকা দিলে পুনরায় সংযোগ দেয়া হয় । তবে আবাসিক সংযোগে গ্যাসের চাপ বুঝে সর্বনিম্ন ২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকাও দিতে হয় ।

তারাব পৌরসভার বাসিন্দা হাসানুর রহমান বলেন, ‘ স্থানীয় প্রশাসন ও তিতাসের সমন্বয়ে কয়েক মাস পর পর অভিযান পরিচালনা করা হয়, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় । প্রশাসন চলে যাওয়ার পর পুনরায় অবৈধ সংযোগ দিয়ে যায় । স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা না থাকলে অবৈধ সংযোগ প্রদান সম্ভব হতো না । ’

ড্রেজার ও বালু ব্যবসায় এমদাদের হাত: সাবেক মন্ত্রীর এপিএস হওয়ার পর ধীরে ধীরে রূপগঞ্জের ড্রেজার ও বালুর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন এমদাদ। রূপগঞ্জে দুটি ড্রেজার থেকে ভোলাব, কুতুবপুর, মোচারতালুক মৌজায় রিমঝিম আবাসনে বালু ভরাটের কাজ চলছে। এমদাদের দাপটের কারণে হাইকোর্টে রিট করেও বালু ভরাট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর আগে সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ড্রেজারে আগুন লাগিয়ে দেয়। সংবাদ চর্চার সম্পাদক মুন্না খান এবং রূপগঞ্জ উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোমেন ও সাধারণ সম্পাদক মকবুল হোসেনের নামে এমদাদের ড্রেজার চলছে এশিয়ান ডুপ্লেক্স টাউনে। কাঞ্চন পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুন্নাহারের নামে এমদাদের ড্রেজার চলছে আমেরিকান সিটিতে। এ ছাড়া ইস্টউড সিটিতে এমদাদের একটি ড্রেজার চলছে। এ ছাড়া রূপগঞ্জের যত ড্রেজার রয়েছে তা থেকে উত্তোলিত বালুর দামের ৫ শতাংশ এমদাদকে দিতে হয় বলে জানা গেছে।

মাদক বাণিজ্য থেকে মাসে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আয়: অভিযোগে বলা হয়, রূপগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন এমদাদ। ভোলাব ইউনিয়নের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন যুবলীগ সভাপতি কাউসার প্রধান, কাঞ্চনে বাছির ও শাহিন মিয়া (লোহা শাহিন)। দাউদপুর, রূপগঞ্জ ইউনিয়ন ও কায়েতপাড়ার চনপাড়ায় শমসের আলী ওরফে ডাকু শমসের, তারাব, গোলাকান্দাইল, ভুলতা, মুড়াপাড়ায়ও রয়েছে এমদাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক। এসব মাদক কারবারির কাছ থেকে মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা চাঁদা তোলেন এমদাদ।

সড়ক ও পরিবহনে চাঁদাবাজি: ভুলতা গাউসিয়ার ফুটপাতে চার শতাধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকানের প্রতিটি থেকে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা তোলেন এমদাদের নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ-যুবলীগের সদস্যরা। চাঁদা না দিলে পিটিয়ে এলাকাছাড়া করা হয়। এ ছাড়া রূপগঞ্জের সব বাজার থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে এমদাদের সন্ত্রাসীরা। এর বড় অংশ যায় এমদাদের পকেটে। এ ছাড়া সিলেট, গাজীপুর, মদনপুর ও ঢাকার সংযোগ সড়কের বিভিন্ন স্ট্যান্ডের পরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে এমদাদের বাহিনী। প্রতিদিন গাড়িপ্রতি সর্বনিম্ন ৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় চালকদের। রূপগঞ্জ স্ট্যান্ডে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা এবং ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার রয়েছে যথাক্রমে প্রায় ২৭০টি, ২৫০টি ও ৮০টি। এর মধ্যে প্রতিটি অটোরিকশা থেকে দৈনিক ৫০ টাকা, লেগুনা থেকে ৬০ টাকা, প্রাইভেট কার থেকে ১০০ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া মাসিক এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা এককালীন চাঁদাও দিতে হয়।

সীমানা পিলার সরিয়ে নদী দখল: শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানা পিলার সরিয়ে এমদাদের ছত্রচ্ছায়ায় নদীর জমি দখল করছে সন্ত্রাসীরা। গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক সেতুর দুই পাশের নদীর তীর দখল করে নিচ্ছে এমদাদ ও তার বাহিনী। রূপগঞ্জের মঠের ঘাট, বানিয়াদি, দড়িকান্দি, আতলাশপুর, হাটাব জেলেপাড়া, পাড়াগাঁও, ইছাখালী, বড় আলু, রূপসী, পূর্বগ্রাম, চনপাড়া, গন্ধবপুরের নদীর দুই পাশের জমি দখল করে বিভিন্ন কম্পানির কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। জমিগুলো আফজাল ফুড, এনডিই রেডিমিক্স, কেপিসি ও রংধনু গ্রুপের দখলে আছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।