https://bangla-times.com/
ঢাকাশুক্রবার , ১৭ নভেম্বর ২০২৩

জাতীয় পার্টিতে ভোটের নাটক

বাংলা টাইমস্
নভেম্বর ১৭, ২০২৩ ৫:৫৭ অপরাহ্ণ । ৫ জন
Link Copied!

নির্বাচন এলেই নাটক শুরু হয়ে যায় জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ থাকাকালীন সময় থেকেই জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সবসময় বহুমুখী চলনের প্রভাব দেখা যায় দলটিতে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই দলটি কার সঙ্গে জোট বাধবে তা নিয়ে কখনো কখনো ত্রিমুখী লড়াইয়েও যুক্ত হয়েছিল।

এরশাদ মারা যাওয়ার পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন জাপা নির্বাচনকে ঘিরে তাদের প্রচলিত নাটকীয়তা থেকে বেরিয়ে আসবে। আবার কেউ কেউ মনে করেছিলেন এরশাদের পর পারিবারিক দ্বন্দ্বে দলটি একেবারেই ভেঙে পড়বে। যদিও নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে এরশাদের মৃত্যুর পর দল ৩-৪টি ভাগে বিভক্ত হয়েছে; কিন্তু নির্বাচনী নাটকীয়তা থেকে বেরিয়ে না এসে বরং সেই চিরায়তরূপ তুলে ধরছে দলটি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির (জাপা) নাটকীয়তায় দেখা দিয়েছে নতুন মোড়। ‘৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে জাপা’ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের এমন ভাষ্যে নির্বাচনী তোড়জোড় শুরু করা নেতাদের অনেকেই এখন সিদ্ধান্ত বদল করেছেন। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিবেশ নেই।

দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে তাদের ৫০ আসনের নিশ্চয়তা দেয়, তবে নির্বাচনে যাবে জাপা। এ নিশ্চয়তা পেলেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেবেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে দলটির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন নেতারা।

নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার যে প্রস্তুতি নিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সদস্য। জি এম কাদেরের পক্ষে নিজেদের অবস্থান জারি রেখে তারা বলছেন, আগামী নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ’ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে দল অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সরকার নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে সে নির্বাচনে যেতে যেন কোনো সমঝোতা না করা হয়, সে লক্ষ্যে শীর্ষ নেতাদের চাপে রেখেছেন তারা।

তবে জি এম কাদেরপন্থি নেতাদের আরেকটি অংশ নির্বাচনে যেতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের নির্দেশনা না এলেও স্থানীয় পর্যায়ে তারা নির্বাচনী তোড়জোড় শুরু করেছেন। ‘দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রয়েছে’ জি এম কাদেরের এমন ভাষ্যই ভরসা জোগাচ্ছে তাদের। তারা বলছেন, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের শিবিরে এই দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে বসে নেই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। বিএনপি, নিবন্ধিত বাম দল ও ইসলামি দলগুলো শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নিলে জাতীয় পার্টি ঠিক কতটি আসনে প্রার্থী দেবে, তা নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন।

বিগত তিন নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারও তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী গাঁটছড়া বাঁধতে চান বলে তার অনুসারী নেতারা জানিয়েছেন। রওশনপন্থি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাজোটের শরিক হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে এবার কতটি আসন মিলবে, তার দেনদরবার শুরু করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা।

বিএনপিসহ দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে যে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছে, গত ৪ নভেম্বর সেই সুরে সুর মিলিয়েছেন জি এম কাদের। দলের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এক সরকার বেশি দিন থাকলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ঢেকে রাখতে পারে না। একটি সরকার বেশি দিন থাকাও অস্বাভাবিক ব্যাপার।’

বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, এ প্রশ্নটি রাজনৈতিক অঙ্গনে জোরেশোরে আলোচিত হতে থাকে। তবে জাতীয় পার্টির নেতারা মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো পরিবেশ নেই।

জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কাজী ফিরোজ রশীদই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে জানান, তারা আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যেতে চান না। কিছুদিন আগে দলের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি কাউকে বৈধতা দেওয়ার জন্য নির্বাচনে যাবে না। কারও ক্ষমতার সিঁড়ি হতেও নির্বাচনে যাবে না জাতীয় পার্টি। বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে যাওয়া হচ্ছে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাঁতার কাটা।’

দলের কো-চেয়ারম্যানদের অনেকে জি এম কাদেরকে নানামুখী চাপে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন জাপার কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের কো-চেয়ারম্যানদের একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘কো-চেয়ারম্যানদের অনেকে চেয়ারম্যানকে নির্বাচনে না যেতে অনুরোধ করেছেন। তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তবে আমাদের দলের সমর্থক, নেতা-কর্মীদের চোখে দলের রাজনৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে চাপ দেওয়ার পরামর্শ দেন কেউ কেউ। তবে আমরা সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দলের চেয়ারম্যানকেই ক্ষমতা দিয়েছি।’

জাতীয় পার্টির ঘাঁটি রংপুর জেলা ও মহানগরে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচার জারি রেখেছেন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য রংপুর মহানগর কমিটির সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রার্থী হবেন বলে যারা নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন, তারা কেউ প্রচার বন্ধ রাখেননি। যদিও দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি, তবু এ মুহূর্তে কেউ নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে যাননি।’ একই কথা জানিয়েছেন খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা।

দলের সংসদ সদস্য ও কো-চেয়ারম্যানদের একজন ঢাকার একটি আসনে ফের প্রার্থী হতে নির্বাচনী প্রচার জারি রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার প্রচার-প্রচারণার ব্যাপারে চেয়ারম্যান মহোদয় কোনো নিষেধাজ্ঞা দেননি। তিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। তবে আমার মনে হয় না জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জন করবে। জাতীয় পার্টির নির্বাচন বর্জনের ইতিহাস নেই।’

জি এম কাদের শিবিরে এমন সিদ্ধান্তহীনতার বিপরীতে রওশন শিবিরের নির্বাচনী পালে হাওয়া লেগেছে। রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ বলেন, ‘বরাবরের মতো এবারও রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এখন জাতীয় পার্টি এককভাবে নাকি জোটগতভাবে নির্বাচন করবে, তা দলের সব কো-চেয়ারম্যানকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন রওশন এরশাদ। তিনি জি এম কাদেরকে সঙ্গে নিয়েই নির্বাচনে অংশ নেবেন।’

এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রী ও রওশন এরশাদপন্থি দুজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রওশন এরশাদ মহাজোটে শরিক হলে অন্তত ৪০টি আসন চাইবেন আওয়ামী লীগের কাছে; যে আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের শরিক দলের কেউ অংশ নেবেন না। জাপার বর্তমান সংসদ সদস্যদের সঙ্গে জাপার সাবেক সংসদ সদস্যদের প্রার্থী করতে তোড়জোড় শুরু করেছেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি গোলাম মসীহ্।

তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জাতীয় পার্টি তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত জানাবে না উল্লেখ করে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘আমরা আশা করব, আওয়ামী লীগ দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে মানুষ সুষ্ঠুভাবে, নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে।